সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ধরনের টানাপোড়েন — কখনও উচ্চ শ্রেণী হিন্দু ভদ্রলোকদের বাহ্যিক অহংকার যার স্বরূপ হিসাবে তাঁরা জোর গলায় দাবি করেছিলেন “আমরা বাঙালি ওঁরা মুসলমান”। অন্য দিকে ওয়াহাবি আর ফরায়েজিদের বক্তব্য ছিল ইসলামীয় শুদ্ধতা আর বাঙালি সত্তার আপাত বিরোধ — অতএব তাঁরা চরমপত্র জারি করেন “হয় মুসলমান নয় তো বাঙালি, দুটি এক সাথে অসম্ভব”।

যাঁরা ১৯৭১এর ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির ক্রমবিকাশ, বিবর্তন ও বাংলাদেশের জন্মের অধ্যায় চোখের সামনে দেখেছেন তাঁদের অনুভূতি, আর যাঁরা পরবর্তী কালে ওই সব গল্পের কথা শুনেছেন বা পড়েছেন কখনই এক হতে পারে না। সেই গভীর আবেগ যার সাথে জড়িয়ে ছিল রাগ, ক্ষোভ, উত্তেজনা, আশা, স্বপ্ন আর এক অদ্ভুত বুকফাটা গর্ব-- আর কোনো দিন বাঙালি জাতি ঠিক ওই ভাবে ওই উল্লাস উপলব্ধি করতে পারবে কি না সন্দেহ। আজ পঞ্চাশ বছর পরেও আমরা যতই বিশ্লেষণ করিনা কেন এর সদুত্তর পাওয়া সত্যিই দুষ্কর।

স্বাধীনতার সময় ভাষা এক হলেও আমরা ৭৫ বছর আগেই পৃথক হবার নির্ণয় নিয়েছিলাম। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ হয়েছিল স্ব-ইচ্ছায় এবং দুই তরফের সুবিধার্থেই। বাঙালির ঐক্য চূর্ন করার জন্যে অবশ্য জিন্নাকে এক ভয়ঙ্কর দাঙ্গা বাধাতে হয়েছিল। তার আগে পিছে দুই সম্প্রদায়ের চরমপন্থীদেরই বিষ ও বিদ্বেষ ছড়াতে অনেক খাটতেও হয়েছিল। সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ধরনের টানাপোড়েন--কখনও উচ্চ শ্রেণী হিন্দু ভদ্রলোকদের বাহ্যিক অহংকার যার স্বরূপ হিসাবে তাঁরা জোর গলায় দাবি করেছিলেন “আমরা বাঙালি ওঁরা মুসলমান”। অন্য দিকে ওয়াহাবি আর ফরায়েজিদের বক্তব্য ছিল ইসলামীয় শুদ্ধতা আর বাঙালি সত্তার আপাত বিরোধ - অতএব তাঁরা চরমপত্র জারি করেন “হয় মুসলমান নয় তো বাঙালি, দুটি এক সাথে অসম্ভব”। তাঁদের এই লাগাতার প্রচার কে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করল কোটি কোটি বাঙালি মুসলমান। তাঁরা প্রমানও করলেন যে এটা সম্ভব। ও দিকে গোঁড়া হিঁদুরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে মুসলমানের হাতে খাবার বা জল গ্রহণ করলে জাত আর ধৰ্ম দুটিই যাবে। কিন্তু এ সত্ত্বেও দু সম্প্রদায়ের লোকই জানতেন, বুঝতেন ও মানতেন যে তাঁদের যৌথ আঞ্চলিক সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সভ্যতার পার্থক্য এতই প্রকট যে বাঙালিসত্তাটি-ই সব বাধা অতিক্রম করে তার আধিপত্য বিস্তার করতে সফল হয়েছে। আসলে যে অন্তর্নিহিত বাঙালিত্ব আগাগোড়াই ছিল আর তা উপলব্ধি করলেন যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্বের বাঙালিদের বুঝিয়ে দিলেন যে বাঙালিত্বের কোনও স্থান নেই।

পশ্চিম বাংলার মানুষকেও প্রচুর দুঃখের সাথে মানতে হয়েছিল যে তাঁরা আর ভারতবর্ষের শীর্ষে নেই বরং বাকি বিশ-বাইশটি প্রদেশের মত একটি অতি সাধারণ রাজ্য। ওপারের বঙ্গভাষীরা কিন্তু প্রথম থেকেই তাঁদের মতামত আর আপত্তি একেবারে স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছিলেন। পাকিস্তানের উদ্ধত রাষ্ট্রপতি জিন্না যখন ২১ মার্চ ১৯৪৮-এ ঢাকায় এসে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের সামনে গর্জন করে বলা সত্ত্বেও তাঁদের ঘাবড়াতে পারেননি তিনি যথেষ্ট হুমকির সুরে শাসিয়ে গেলেন যে উর্দু কে তাঁদের জাতীয় ভাষা হিসাবে মানতেই হবে। এর যোগ্য জবাব দিলেন ভাষা আন্দোলন দিবসের চার শহীদ-- আব্দুস সালাম, রফিকুদ্দীন আহমেদ, আবুল বরকত আর আব্দুল জব্বার। এই রক্তেরাঙা একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস বলে স্বীকৃতি পেল ও অমরত্ব লাভ করল। এর জের টেনে প্রায় দুই শতক লড়াই চালাল ওপার বাংলার মানুষ।অবশেষে তাঁদের অপরিসীম ত্যাগ ও বীরত্বেরই জিত হল। কয়েক লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পেল এক স্বাধীন দেশ।

নূতন বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের কাছে একটা গৌরবের বার্তা নিয়ে এল। মাতৃভাষা নিয়ে এমন সংগ্রামের ইতিহাস বিশ্বের কটা দেশেরই বা আছে। সারা বিশ্ব দেখল ভাষার অপরিসীম শক্তি, যা ধর্ম, শ্রেণী ও জাতির ভেদাভেদ কে শুধু তুচ্ছ-ই প্রমান করল না, কয়েক লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করলো তাঁদের জীবন বলিদান দিতে।

বাংলাদেশের জন্ম অবশ্য দু’পারেরই বাঙালি মানুষের দেশভাগের বেদনা আর বন্চিত হওয়ার দুঃখ কিছুখানি কমালো। এত দিন পর বাঙালি সত্তা কে মজবুত করার জন্য যেন নিজেদের homeland বা স্বদেশ ফিরে পেল বাঙালি — যা তারা হারিয়েছিল পলাশীর রণক্ষেত্রে। অতএব ১৯৭১ দু’পারেরই বাঙালির কাছেই খুবই আবেগপূর্ণ। নূতন বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের কাছে একটা গৌরবের বার্তা নিয়ে এল। মাতৃভাষা নিয়ে এমন সংগ্রামের ইতিহাস বিশ্বের কটা দেশেরই বা আছে। সারা বিশ্ব দেখল ভাষার অপরিসীম শক্তি, যা ধর্ম, শ্রেণী ও জাতির ভেদাভেদ কে শুধু তুচ্ছ-ই প্রমান করল না, কয়েক লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করলো তাঁদের জীবন বলিদান দিতে। শেখ মুজিবের মহান ব্যক্তিত্ব তখন কেবল আকাশছোঁয়াই নয় তাঁকে একটি বিশাল জাতির মুক্তিদাতা হিসাবে গণ্য করা হল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার ঘৃন্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করে আমরা সময় নষ্ট না করলেও অনেকেই ভুলতে পারেন নি ওঁদের বিদেশ মন্ত্রী কিসিঞ্জার হেয় করে বলেছিল বাংলাদেশ এক দানপত্র যার চাহিদার কোনো শেষ নেই। পাকিস্তান দেশটিকে শুধু লুটপাট আর ধংস-ই করে নি তার অর্থনীতির মেরুদণ্ড সম্পূর্ণ চূর্ন করে গিয়েছিল। বিশাল প্রতিবেশী ভারতের পাশে দেশটিকে কতই না ছোট্ট মনে হতো। আজ সেই বাংলাদেশ কত বিষয়ে ভারতের চেয়ে এগিয়ে গেছে। ২০০৭এ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল অর্ধেক আর ২০২০-২১এ দেখা গেল সেই আয় আমাদের চেয়ে ২৮০ ডলার বেশি। টানা সাত বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশ global gender gap index এ অনেক এগিয়ে। শেষ হিসাব অনুযায়ী ১৫৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান লজ্জাদায়ক ১৪০ নম্বরে আর কিছু সময়ের পরেও বাংলাদেশ ৬৫এ। এই নিরীক্ষার বিচার হয় অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহন ও তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকরণের ভিত্তিতে। এর সাথে নির্ধারণ করা হয তাঁদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা যা নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নতির মান চিহ্নিত করে। দেখা যাচ্ছে এর সব কটিতেই ভারত কি ভয়াবহ ভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রেও একই চিত্র।

এত প্রতিকূলতা সত্তেও বাঙালি কি ভাবে অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে ও করে চলেছে এর চেয়ে ভাল প্রমান হতে পারে না। ১৯৭১এর আসল তাৎপর্য শুধু বাঙালির সত্তার জয়ই নয়, বাঙালির কর্মক্ষমতা ও তাঁরা কি অর্জন করতে পারেন তার এক দৃষ্টান্ত।

No comments on 'অবিস্মরণীয় গৌরবসিক্ত এক অর্জন'

Leave your comment

In reply to Some User