আপাতদৃষ্টিতে এই কাজটি ভাল মনে হলেও এর আসল উদ্দেশ্য কিন্তু ব্যাংকের সাহায্য করা নয়। বরং তাদের হিসাবনিকাশপত্র পরিষ্কার করতে পারলে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকের ঝকঝকে রূপ দেখিয়ে শাসক তাদের প্রিয় ধনকুবেরদের বেচে দিতে পারবে।

অনেকেই বোধহয় নরেন্দ্র মোদীর ‘Bad Bank’ নামক নূতন এক ফন্দির কথা শোনেন নি। এই ব্যাংকের ভাল নাম অবশ্য বেশ গালভরা National Asset Reconstruction Company Ltd, বা এন এ আর সি এল যার মানে জাতীয় সম্পদ পুনর্গঠন কোম্পানি। মোদীর মন্ত্রিসভা গত ১৫ সেপ্টেম্বরে এর অনুমোদন দিয়েছে। এই সংস্থাকে অর্থনীতিবিদরা bad বলার কারণ এর কাজ হল সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের যত bad বা অনাদেয় ঋণ এটির ঘাড়ে চাপান হবে। এই ব্যাংকটি অনেকখানি নীলকণ্ঠের মতন হয়ে উঠবে।

আপাতদৃষ্টিতে এই কাজটি ভাল মনে হলেও এর আসল উদ্দেশ্য কিন্তু ব্যাংকের সাহায্য করা নয়। বরং তাদের হিসাবনিকাশপত্র পরিষ্কার করতে পারলে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকের ঝকঝকে রূপ দেখিয়ে শাসক তাদের প্রিয় ধনকুবেরদের বেচে দিতে পারবে। গত ৫ বছর ধরে লাগাতার রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকেরা যতই লাভ করে থাকুক না কেন অনাদেয় ঋণের জন্যে তাদের হিসাব খাতায় প্রভিশণ বা সংস্থান করে শেষে প্রচুর লোকসান দেখাতে হয়েছে। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে ব্যাংকেরা প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকার লাভ করেও তারা শেষে ২৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি দেখাতে বাধ্য হয়েছে কেননা তাদের অনাদায় ঋণের খাতে ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি রাখতে বাধ্য হয়েছে। এই ঋণের বোঝা দেখিয়ে ব্যাঙ্কদের দোষী সাব্যস্ত করা যায় ঠিকই কিন্তু তাদের বিক্রি করা যায় না। অতএব গত আর্থিক বছরে হঠাৎ ব্যাংকের ৩১,৮১৭ কোটি টাকার লাভ জাহির করা হয়েছে। কিন্তু যত স্বজন পোষণ করাই হোক না কেন রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকেরা এখনও ৬ লক্ষ কোটি টাকার বেশি অপ্রাপ্য দায় নিয়ে চলছে। অতএব এই নূতন এন এ আর সি এল ব্যাংকের মাধ্যমে এর একটি বড় অংশ যদি চুষে নেওয়া যায় তবে নরেন্দ্র মোদী ধাপে ধাপে আমাদের বৃহৎ ব্যাংক এবং তাদের লক্ষ লক্ষ কাস্টমার ও ব্রাঞ্চ নিলাম করে তাঁর প্রিয় ব্যবসায়ীদের হস্তান্তর করতে পারবেন। ঠিক যে ভাবে তারা বিনা মেহনতে এয়ারপোর্ট, সমুদ্র বন্দর, জাতীয় সড়ক ও টোল ব্রিজ পেয়েছে সেই ভাবেই এবার তারা ব্যাংক পেতে চলেছে।

মোদীর আমলে দেউলিয়া আইন লাগু করে অনেক রকমের কার্যকলাপ চলছে গত পাঁচ বছর ধরে। বিগত তিন বছরে ৩২৪ টি কোম্পনি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্যে আবেদন জনিয়েছে যাতে তাদের ঋণ ফেরত না দিতে হয় বা তাদের কাছ থেকে দেনার যত কম অংশ সম্ভব নেওয়া হয়।

১৫ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা নূতন এন এ আর সি এল ব্যাংকের জন্যে ৩০,৬০০ কোটি টাকার গ্যারান্টি মঞ্জুর করেছে। এই সংস্থাটি রিজার্ভ ব্যাংকের লাইসেন্স পেলেই ব্যাংকের কাছে থাকা বড় মাপের রুগ্ন কোম্পানিগুলি কিনতে আরাম্ভ করবে মাত্র ১৫ শতাংশ মূল্য দিয়ে আর বাকি অর্থের বিনিময়ে তারা দেবে সরকারি গ্যারান্টি। তারপর তারা আবার একটি নূতন সম্পদ পুনর্গঠন কোম্পানির মারফত এগুলিকে ঋণের বোঝা সমেত বিক্রি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু এই সম্পদ বেচার ইতিহাসও যথেষ্ট দুঃখজনক। মোদীর আমলে দেউলিয়া আইন লাগু করে অনেক রকমের কার্যকলাপ চলছে গত পাঁচ বছর ধরে। বিগত তিন বছরে ৩২৪ টি কোম্পনি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্যে আবেদন জনিয়েছে যাতে তাদের ঋণ ফেরত না দিতে হয় বা তাদের কাছ থেকে দেনার যত কম অংশ সম্ভব নেওয়া হয়। ব্যাংকগুলি তাদের মোট প্রাপ্যের ২৫ থেকে ৩৩ শতাংশ পেলে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছে। ভিডিওকনের মতন নামি দামি সংস্থা এক ধনকুবেরকে বিক্রি করা হল তাদের কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণের মাত্র ৪ শতাংশ মূল্যে দিয়ে। রুচি ইন্ডাস্ট্রিজের ক্ষেত্রে ব্যাংকের বাবা রামদেবের পতঞ্জলি আয়ুর্বেদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে ৯৩.৫ শতাংশ দায় মকুব করা হল। এই রকম প্রচুর উদাহরণ আছে।

সরকার বারংবার বলে যাচ্ছে যে এই দেউলিয়া ঘোষণার কারণ কেবলমাত্র ব্যাংক এবং কোম্পানিদের নিজেদের খাতা পরিষ্কার করার জন্যে ঋণ ফেরতের জন্যে নয়। আমাদের মৌলিক প্রশ্ন হল বড় বড় শিল্পপতিদের ব্যবসা যখন দেউলিয়া বলে চিহ্নিত করে দায় মুক্ত করা হয় তখন মালিকদের দেউলিয়া ঘোষণা করা হয় না কেন? কোটিপতিরা তো দিব্যি তাদের বিশাল ধন সম্পত্তি তাদের অন্য সংস্থার নামে ভোগ করে যায় আর নূতন নূতন দরখাস্তের পিছু আবার শত শত কোটি টাকার লোন পান। যারা কুকীর্তিতে হাতে নাতে ধরা পড়েন তারা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ-ও পেয়ে যান। বিগত ৮ বছরে ব্যাংকের মোট ১০.৮ লক্ষ কোটি টাকা মকুব করেছে, মানে এই অপ্রাপ্য ঋণের নামে লোকসান করেছে। এই সংখ্যাটি কিন্তু অনেক রাজ্যের বাৎসরিক বাজেটের থেকে অনেক বেশি। আর সম্পূর্ণ টাকাগুলি আপনার আমার, তা ব্যাংকেরা সরাসরি লস দেখাক বা সরকারি অনুদান হিসাবে আসুক।

এই নুতন Bad Bank বা এন এ আর সি এল সরকারের একটি চালাকি ছাড়া আর কিছু নয়।।

No comments on ' বেচারামের নয়া ফন্দি Bad Bank'

Leave your comment

In reply to Some User