নরেন্দ্র মোদী নিজেকে এক অতিমানব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক যিনি হিন্দু ধর্মকে ইসলামের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবেন, সত্যিকারের লৌহমানব যাঁকে সবাই ভয় পায়, এক বিশ্বগুরু যাঁকে সত্তর বছরের কংগ্রেসী অপশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে খোদ দেবতারাই পাঠিয়েছেন।

নরেন্দ্র মোদী তাঁর তাঁর কৃষি আইন বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বহ কৃষক ও সাধারণ মানুষ উল্লসিত হয়েছেন। কিন্তু দল ও মিডিয়ার মধ্যে মোদীর অনুরাগীরা বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন। বিগত এক বছর ধরে তাঁরা কৃষি আইনের পক্ষ নিয়ে সোচ্চার হয়ে ক্রমাগত কৃষকদের খালিস্তানি, রাষ্ট্রবিরোধী ও সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে এসেছেন।

যাঁরা মোদীকে চেনেন তাঁরা কিন্ত একটুও মনে করছেন না যে তাঁর হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে। বহু সমালোচক তো মনে করেন তাঁর হৃদয় নামক বস্তুটি নেই। কিন্তু এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে গোয়েন্দা সংস্থা ও সংঘ পরিবার অবশেষে সাহস জুটিয়ে মোদীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে তাঁর অতি প্রিয় কৃষি আইন বাতিল না করার জেদ ওঁর পক্ষে খুব সুখকর হবেনা। ইতিহাস সাক্ষী আছে মোগল সাম্রাজ্যের পতন তরান্বিত হয়েছিল জাট, রাজপুত, মুসলমান রোহিলা ও শিখেদের কারণে যারা দিল্লী ঘিরে ফেলেছিল এবং মারাঠারা দূর থেকেই আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। বর্তমানে সেই শিখ, জাট ও মুসলমানেরা দিল্লীর আশেপাশে মোদীর বিরোধিতা করেছেন ও সুদূর মহারাষ্ট্রে বসে শিব সেনা মোদীকে নাস্তানাবুদ করার সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।এই কারণেই বেড়াল তার নিজের গলার ঘন্টা নিজেই বাঁধার সিদ্ধান্ত নিল কৃষি আইন বাতিলের ক্ষেত্রে। এটি করার ফলে অবশ্য মোদী-ভক্তবৃন্দের এক বৃহদাংশ যাঁরা তাঁর আক্রমণাত্মক পুরুষ সিংহ ইমেজ ও দৃঢ়তার বড়াই করতেন তারা রুষ্ট ও লাঞ্ছিত বোধ করেছেন এখন শাক দিয়ে মাছ ঢেকে বলতে হচ্ছে যে তাঁর মহত্বের কারণ হল তাঁর অনির্দেশ্যতা এবং কেউই যেন তাঁকে নিশ্চিত ভাবে না ধরে নেন।

নরেন্দ্র মোদী নিজেকে এক অতিমানব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক যিনি হিন্দু ধর্মকে ইসলামের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবেন, সত্যিকারের লৌহমানব যাঁকে সবাই ভয় পায়, এক বিশ্বগুরু যাঁকে সত্তর বছরের কংগ্রেসী অপশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে খোদ দেবতারাই পাঠিয়েছেন। সমস্যা হল,মোদী তাঁর এই মেকি ভাবমূর্তি গড়ার পর প্রচুর সাফল্য লাভ করেছেন। তাই শুধু নয়, তিনি নিজেও তাঁর এই অলীক ছবিটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। এটাই এখন প্রধান এবং গুরুতর সমস্যা। যখন কোন বড় নেতার মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে তাঁকে স্বয়ং ঈশ্বর পাঠিয়েছেন— যেমনটি ভেবেছিলেন হিটলার , পল পট বা ইদি আমিন -- তখন বিশাল ধ্বংস ব্যতীত কোন কিছুতেই তাঁকে রোখা যায় না।

২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক জানিয়েছিল মোদীর প্রথম সাড়ে তিন বছরে প্রচার কার্যে ব্যয় হয়েছিল ৪৫০০ কোটি টাকা যা ইউ পি এ সরকারের দশ বছরের খরচেরও ডবল।

কয়েকটি নমুনার উল্লেখ করলে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট বোঝা যাবে। যেমন কত সূক্ষ্ম চাল খেলে এক ক্রুর ও স্বার্থপরায়ণ মুখ্যমন্ত্রী যিনি একটি জঘন্য মুসলমান নরহত্যার জন্য দায়ী তাঁর সম্পূর্ণ ভাবমূর্তি কি আশ্চর্য় ভাবে বদলে দেশের সবচেয়ে দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠলেন। এক অসংশোধনী মিথ্যাবাদী এই ব্যক্তি তাঁর অতীতকে সুন্দর মোড়কে বর্তমানের মধ্যে সাজিয়ে দিয়ে "মার্কেটিং" করলেন এ কথা বলে যে শৈশবে দারিদ্র্যের কারণে তিনি চা বিক্রি করতেন এক রেল স্টেশনে। উল্লেখনীয় এই স্টেশনটি তৈরী হয়েছে তিনি শহর ছেড়ে যাওয়ার অনেক পরে। উনি দাবী করেন যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্ব অতিক্রম করেছেন অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেন না বা ডিগ্রিও প্রকাশ করেন না। আমেরিকান মনস্তত্ববিদ ডেভিড জে লেয় বলেছেন "প্যাথলজিকাল" মিথ্যার কোন রোগ নির্ণয় হয়না যদিও এটি অন্য কিছু সমস্যার লক্ষণ যেমন "পার্সোনালিটি ডিসর্ডার" অথবা "ম্যানিক এপিসোড"। মোদী এতটাই নিশ্চিত যে তিনি এক সফল ছাত্র ( যার কোন প্রমাণ নেই) যে তিনি লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীদের সফল হবার পরামর্শ দেন।

আত্ম বিভ্রান্তি অবশ্য মূল্যবান পরিধানের ক্ষেত্রে কোন রকম ভাবেই বাধা সৃষ্টি করেনা। উদাহরণস্বরূপ- মোদীর সেই বহু লাখ টাকার বিশেষ ভাবে তৈরী স্যুট যার কাপড়ের মধ্যে তাঁর নাম সূতোতে বোনা আছে। এক কথায় বলা যেতে পারে দারিদ্র্য ও দর্প তাঁর কাছে সমগোত্রীয়। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে প্রধানমন্ত্রীর পদে কতখানি সময় ও অর্থ (নিজের না সরকারের বোঝা মুশকিল) তিনি অপব্যয় করেছেন কেবলমাত্র নিজের বিভিন্ন ধরনের কুর্তা, জহরকোট, শাল, পাগড়ি ও অঙ্গবস্ত্রের সজ্জার পেছনে। শত শত সরকারী প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রক, বিভাগ ও কর্পোরেশনকে নির্দেশ দেওয়া আছে তাদের কৃতিত্বের মূলে যে এই ব্যক্তি সে কথা যেন সব জায়গাতেই প্রতিফলিত হয়। ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক জানিয়েছিল মোদীর প্রথম সাড়ে তিন বছরে প্রচার কার্যে ব্যয় হয়েছিল ৪৫০০ কোটি টাকা যা ইউ পি এ সরকারের দশ বছরের খরচেরও ডবল। এ সত্ত্বেও করণ থাপারের বিখ্যাত ইন্টারভিউতে মোদীর বলতে একবারও বাধেনি " আমি একটি মুহূর্ত-ও নিজের ইমেজের পেছনে দিইনা.... ইমেজের কথা বলিনা।"

এই "প্যাথলজিকাল মিথ্যা" ব্যাধির প্রমান করেন যখন তিনি সত্যের থেকে বেশী প্রাধান্য দেন আত্ম অহংকার বা আত্ম বিভ্রম কেই। তাই মোদী চাননা কেউ তাঁকে ছাপিয়ে যাক বা ভাবতেও পারেননা যে প্রতিবাদী কৃষকরা তাঁকে কোণঠাসা করে হার স্বীকার করাতে পারেন। উনি আইন বাতিল করে কেবলমাত্র উদার নেতার অভিনয় করেছেন মানুষের সমর্থন আর সহানুভূতি পাবার জন্যে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

সন্দেহ নেই যে সুযোগ পেলেই মোদী তাঁর প্রবল শক্তির আরও বেশী প্রদর্শন করবেন। কারণ ওঁর চরিত্রে পিছু হঠা, অনুশোচনা বা আপোষের কোন স্থান নেই। তাই এই অবকাশে নিজেদের প্রতিবাদ ও সংঘটন আরও জোরালো করে তুলতে হবে আমাদের। মোদী কিন্তু আঘাত হানতে একটুও সময় নষ্ট করবেন না।

No comments on 'মোদীর মানসিকতা অতি ভয়ংকর'

Leave your comment

In reply to Some User