যাঁরা দেখেছেন কী কঠিন ভাবে এই দুই দলের জামানায় তিনি তাঁর মতামতের স্বাধীনতা বজায় রেখেছিলেন। প্রলোভন আর রাজনীতির প্রচন্ড চাপ সহ্য করা সত্যি খুবই কঠিন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দুঃখজনক মৃত্যুর পর ওঁকে নিয়ে প্রচুর লেখা বেরিয়েছে, আরও নিশ্চয় বেরোবে। এই মাপের একজন অভিনেতা, আবৃত্তিকার বা সম্পূর্ণ বাচিক শিল্পী পাওয়া সত্যিই বিরল। আর তার সাথে সাথে তিনি যে কবি, নাট্যকার ও প্রকাশকও ছিলেন তা সাধারণ লোক বোধ হয় খুব বেশি জানেন না। এত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি সারা জীবন একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙাlলিই থেকে গেলেন। ছিলেন এক স্পষ্ট সহজ স্বচ্ছ মানুষ। আর্থিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা পদের লোভ ছিল না বলেই তাঁকে কেউ বাগে আনতে পারেনি। তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও স্বাধীনতা সম্পুর্ন না হলেও যথেষ্ট বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সংস্কৃতির জগতে এত লোককে দেখেছি তাঁদের নীতি ও বিশ্বাসকে বেচে দিতে, যে সত্যি সত্যি ঘৃণা লাগে। এই রাজ্যে ২০১১তে যেই মুহূর্তে বামেদের ৩৪ বছর শাসনের সমাপ্তি হল দেখা গিয়েছিল এই রঙবদল। খুবই দৃষ্টিকটু আর অনেক খানি নির্লজ্জ ভাবে হয়েছিল।

অতএব সেদিন যখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে প্ৰাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রবীন্দ্র সদনে চলে এসেছিলেন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। স্বাস্থ্যের কারণে তিনি আজকাল একদম কোথাওই যান না। অভিনেতাকে শুধু সম্মানই জানান নি, তাঁকে তিনি লাল সেলামও দিলেন। অবশ্য বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আরও সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান ছিলেন আর তাঁর উপস্থিতি সবচেয়ে লক্ষণীয়। ঠিক যেমন তিনি সব জায়গায় থাকেন। আর সব অনুষ্ঠান নিজেই পরিচালনা করেন। কিন্তু সকলেই সত্যি আশ্চর্য হলেন যখন দেখলেন শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আর তাঁদের চরম বিরোধী মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির অধিনায়করা পাশাপাশি না হলেও এক সাথে ঘাট অব্দি পদযাত্রা করলেন।

সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হলেন যাঁরা সৌমিত্র বাবুর রাজনৈতিক মতবাদ জানতেন। এবং যাঁরা দেখেছেন কি কঠিন ভাবে এই দুই দলের জামানায় তিনি তাঁর মতামতের স্বাধীনতা বজায় রেখেছিলেন। প্রলোভন আর রাজনীতির প্রচন্ড চাপ সহ্য করা সত্যি খুবই কঠিন। অনেকেই জানতেন যে অল্প বয়স থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সেই আদর্শকে তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তিনি নিজের কাজের সাথে কখনো জড়াতেন না। তাঁর ভাবাদর্শের জন্য তিনি অন্তরে গুছিয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। তাঁর এই বাম অনুরাগ ছিল এক মুক্ত স্বাধীন সমর্থকের আর চিন্তাশীল ব্যক্তির। তিনি কোন কমিউনিস্ট বা সোসালিস্ট দলের সদস্য ছিলেন না, আর হওয়ারও যে খুব একটা ইচ্ছে ছিল তা মনে হয় না। পার্টির নির্দেশে ওঠাবসার লোক তিনি ছিলেন না। অন্তত এটাই আমাদের অনুমান -- আমরা যারা তাঁকে তাঁর মধ্যে বয়সে পেয়েছি। তিন দশকের বেশী তাঁকে যথেষ্ট কাছের থেকে দেখার পরে এই ধারণা হওয়া স্বাভাবিক।

তাঁর কফি হাউসের আড্ডা আর বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার গল্প আমরা সকলেই জানি। যেটা অনেকে বোধহয় কম জানেন হল তাঁর প্রকাশনার কাজ। মাত্র ২৫-২৬ বছর বয়সে তিনি নির্মাল্য আচার্যের সাথে 'এক্ষন' লিটিল ম্যাগাজিন স্থাপন করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের অনেক উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়েছিলেন। বেশ কয়েকজন বামপন্থী লেখক শিল্পীরাও সাহায্য করেছিলেন। আর সকলের ডেরা ছিল প্রখ্যাত radical অবনী রঞ্জন রায়ের কথাশিল্পের দপ্তরে। সেই বিখ্যাত ১৯ নম্বর শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসের খুবই কাছে। মার্ক্সিয় চিন্তাধারার হরেক রকম ভিন্ন দর্শনের বুদ্ধিজীবীরা এখানে আসতেন ও আলাপ আলোচনা বিতর্ক করতেন। অবনী বাবুর কথাশিল্পের অফিসে জড়ো হতেন চিত্তপ্রসাদ, খালেদ চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও অন্য অনেক ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্য বা প্রাক্তন সদস্য। ঘন্টার পর ঘন্টা কত কথোপকথনে নিজেদের ব্যস্ত রাখতেন। এঁরা কেউ কিন্তু পার্টির সদস্য ছিলেন না। প্রায় সকলেই এক অর্থে স্বাধীন চিন্তার পার্টিহীন কমিউনিস্ট বা বামপন্থী। এই আবহাওয়াতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষা পেয়েছিলেন। পুলিশ কিন্তু এঁদের ওপরেও নজর রাখতেন। ১৯৬২ তে চীনের আক্রমণের পর যখন কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল তখন কে পার্টির সদস্য আর কে নীতির সমর্থক বিচার করা মুশকিল ছিল। আজকের পার্টি কেন্দ্রিক রাজনীতির দুনিয়ায় অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না এই দল বিহীন নিঃস্বার্থ স্বাধীন বামপন্থী আর প্রতিবাদী কাকে বলে।

পেশাগত অভিনেতা ও উচ্চমানের সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে তাঁর যা প্রাপ্য ছিল তাও সবসময় পান নি, বা বিশেষ কিছু চানও নি। তিনি মনে করতেন তাতে তাঁর স্বাধীন চিন্তার উপর ছায়া পড়তে পারে।

সত্যি নিরপেক্ষ কি না যাচাই করার জন্যে আমরা বেশ কয়েকটি ঘরোয়া আড্ডায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে অনেক রাজনৈতিক বিষয় বা ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন বা জেরা করেছি। কয়েক বার তুমুল তর্কও হয়েছে। আমরা কখনও দেখিনি তিনি কোন দলের হয়ে সওয়াল করছেন। অন্য অনেক সাম্যবাদী ও গণতন্ত্র প্রেমী মানুষদের মতন তিনিও বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রচুর প্রত্যাশা পোষণ করেছিলেন। তারপর হতাশও হয়েছিলেন। রাজনৈতিক মতবাদ কাছাকাছি হলেও ওই জামানায় তিনি সরকার বা পার্টির ঘনিষ্ঠ হওয়ার কোন চেষ্টা করেন নি বা ওঁদের ইঙ্গিতেও সায় দেন নি। পেশাগত অভিনেতা ও উচ্চমানের সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে তাঁর যা প্রাপ্য ছিল তাও সবসময় পান নি, বা বিশেষ কিছু চানও নি। তিনি মনে করতেন তাতে তাঁর স্বাধীন চিন্তার উপর ছায়া পড়তে পারে। কয়েকটি ব্যাপারে শিল্পী ও নাগরিক হিসাবে যেমন বামেদের সমর্থন করেছেন ঠিক তেমনই বেশ কয়েকটি বিষয়ে তিনি তাঁদের পদক্ষেপকে মানেন নি আর প্রকাশ্যে তা স্পষ্ট করে বুঝিয়েছেন। কোন বিশেষ কারণে তিনি সব জায়গায় মতামতও দিতেন না বা দেন নি। সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার।

বর্তমান রাজ্য সরকার পূর্বপরিকল্পিত ভাবে নামী শিল্পীদের নিজেদের দিকে টেনে নিয়েছে। অবশ্য অনেক প্রাক্তন বাম অভিনেতা, গায়ক, চিত্রশিল্পী, লেখক ও কবি লাফাতে লাফাতে তাঁদের দিকে গেছেনও। উঁচু পদ পেয়েছেন আর তাঁদের কাঁধে উত্তরীয় চাপিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ওঁদের বড় বড় নামের সম্মানও দিয়েছেন। সৌমিত্র বাবু এই সব থেকে তাঁর দূরত্ব বজায় রেখেছেন আর যথেষ্ঠ সাহসের পরিচয়ও দিয়েছেন। জীবনের শেষে পৌঁছেও তিনি হাত বাড়ান নি। যখন প্রয়োজন হয়েছে সবার সামনে তাঁর স্পষ্ট বাক্যে সরকারের সমালোচনা করতে দ্বিধা করেন নি। মাথা উঁচু রেখেছেন। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর এক বিশেষ বিদ্বেষ ছিল। তিনি জানতেন যে কেন্দ্রীয় শাসক দল বা ওদের মহান নেতা কে সমালোচনা করলেই তীব্র আক্রমণের শিকার হতে হয়। কিন্তু তা সত্তেও তার প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন শেষ জীবন পর্যন্ত। আমাদের অনেক কে এই পথে সাহস জুগিয়েছেন, সমর্থন করেছেন। সত্যি প্রশংসনীয় দুঃসাহস দেখিয়েছেন।

এই সব কথা এখন স্পষ্ট করে বলার দরকার আছে। আর বোঝারও প্রয়োজন। অনেক জায়গায় শোনা যায় এই নেতা বা নেত্রী তাঁর জন্যে এই করেছেন বা কোন দল তাঁকে বিশেষ সাহায্য করেছিল। হ্যাঁ, শেষ চিকিৎসার বা ওঁর অন্তিম লড়াইয়ের সময় রাজ্য সরকার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তাই- ই তো হওয়া উচিত। এতে তাঁর মুক্ত চিন্তার উপর কোন আঘাত পড়েছে বলে মনে হওয়ার কারণ নেই। রাজ্যের এক যোগ্য সন্তানের জন্য এইটুকু তো সব সরকারই করে। এই ঘটনা ছাড়া আর যত সব কানাঘুষো শোনা যায় প্রায় সবই রটনা বা উড়ো কথা। আসল ব্যাপারটা হল স্বাধীন চিন্তা অনেকেই সইতে পারে না। বুঝতে পারেনা একজন বিখ্যাত ব্যক্তি এত নোংরা রাজনীতির মাঝে স্বাধীন কি করে থাকতে পারে। আর সত্যি কথা বলতে এই রকম একজন মুক্ত চিন্তার সাম্যবাদী মানুষ পাওয়া তো দুর্লভ।

No comments on 'শেষ অবধি তিনি মাথা উঁচু রেখেছিলেন'

Leave your comment

In reply to Some User