রথমেই বলে নেওয়া ভাল, গত অর্ধশতকে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান যে চারটি দলের সঙ্গে আমার পরিচয়, তার কোনওটির প্রতিই আমার অনুরাগ নেই। ১৯৭৫ সালে যখন আইএএস-এ যোগ দিই, তখন জরুরি অবস্থা চলছে। খুব কাছ থেকে দেখেছি, কংগ্রেস কী ভাবে ‘মিসা’ প্রয়োগ করে, বিরোধীদের যথেচ্ছ গ্রেফতার করে এবং কণ্ঠরোধ করে গণতন্ত্রকে পদদলিত করেছে। বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছরের শাসনকালে তেইশ বছর সেই সরকারের অধীনে কাজ করেছি। তখন একদলীয় রাষ্ট্রের উত্থান, প্রতি স্তরে ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন এবং বিরোধীকে কোণঠাসা করার রীতিও দেখেছি। আর্থসামাজিক ন্যায় পাওয়ার উদ্দেশ্যে ‘অপারেশন বর্গা’ নিয়ে আমাদের গোড়ার উৎসাহ ক্রমশ স্তিমিত হয়ে এল, যখন দেখলাম গ্রামে ‘বয়কট’ করার মারাত্মক ফল, মাফিয়াদের মাথা চাড়া দেওয়া, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নেতাদের দহরম-মহরম।

নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের আন্দোলন আর তার জেরে ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতায় আসার সময়টাতে আমি দিল্লিতে ছিলাম। কিন্তু নিজের রাজ্যে কী হচ্ছে, বিশদ খবর রাখতাম। ২০১৬ সালে যখন কলকাতা ফিরলাম, তত দিনে তৃণমূল সরকারের ভয়ঙ্কর চেহারা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তারা যে কেবল বামেদের দমন-পীড়ন করছে তা-ই নয়, সে খেলাটা বামেদের চাইতেও ভাল শিখে গিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, স্রেফ অবসরপ্রাপ্ত খিটখিটে লোক বলে পরিচিত না হয়ে থেকে, সরকারের উপদেষ্টা হয়ে গিয়ে নীল আলোর গাড়ি, মাসে কয়েক লক্ষ টাকা রোজগার, পুলিশ-প্রশাসনে ছড়ি ঘোরানো, কিছুই আর হল না। বিবেক বাধা দিল।

এত কথা বলার কারণ এই যে, আমি আগে যা কিছু দেখেছি, তা মনে রেখেও বলতে হচ্ছে, আমার রাজ্য ও দেশ সম্পর্কে আজ, এই মুহূর্তে আমি বেশি ভয় পাচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গ কি সত্যিই বাকি দেশের মতো (হয়তো কেরল আর পঞ্জাবকে বাদ দিয়ে) সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে ভোট দিয়েছে?

গত দু’মাস ধরে বোঝার চেষ্টা করছি, ঠিক কী ঘটল এপ্রিল-মে মাসের লোকসভা ভোটে। আমার ধারণা, এখনও এ রাজ্যের আশা রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ, সহিষ্ণু রাজ্য হয়ে থাকার। কিন্তু সহিষ্ণুতা আগে আসতে হবে শাসক দলের কাছ থেকে, যা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার কথা বলেও কাজের বেলা আসলে গণতান্ত্রিক বিরোধীদের প্রতি সম্পূর্ণ অসহিষ্ণু। অটলবিহারী বাজপেয়ীর গণতান্ত্রিক দক্ষিণপন্থী আন্দোলনের প্রতি আপত্তি করার তেমন কিছু নেই, কিন্তু তৃণমূলের ঔদ্ধত্যের জন্য যে ভাবে এক ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক শক্তি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার দিকে এগোচ্ছে, তা সত্যিই ভীতিপ্রদ। শাসক দল যে ভাবে বিরোধী দলের প্রতিটি কর্মীর উপর ক্রমাগত দমন-পীড়ন চালিয়েছে, তার তুলনা হয় না। কংগ্রেসের বাড়াবাড়ি বামেদের এনেছিল, বাম ‘হার্মাদ’ বাহিনী রাস্তা করে দিয়েছিল তৃণমূলকে। তা সত্ত্বেও মনে রাখতে হবে, এরা সবাই বহুত্ববাদ এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। এই দলগুলো তরোয়াল-ত্রিশূল দিয়ে দেশটাকে আধাআধি ভাগ করার ভয় দেখিয়ে, সন্ত্রাস এবং অঘোষিত জরুরি অবস্থাকে চিরস্থায়ী করার দিকে এগিয়ে দেয় না।

আমার প্রজন্মের প্রশাসকরা যে চার দশক দেশের জন্য কাজ করেছে, তার শুরুটা হয়েছিল নাগা এবং মিজ়োদের বিদ্রোহ দিয়ে, যার স্মৃতি এখনও উদ্বেগ জাগায়। তার পর এসেছিল অসম এবং পঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন (দুই জায়গাতেই আমাদের শুনতে হয়েছে, ‘ভারতের কুকুর দূর হটো’)। কাশ্মীর এবং নকশাল-অধ্যুষিত এলাকায় তো উত্তেজনা লেগেই ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছিল কম। আমাদের সমসাময়িক বেশ কিছু অফিসার কর্মরত অবস্থাতেই মারা গিয়েছেন, অধিকাংশই মানসিক চাপ, আত্মহত্যার জন্য, বাকিরা কেউ কেউ অন্য ধরনের মানসিক বিবশতা থেকে।

ভারতের ঐক্যকে অক্ষুণ্ণ রাখা আমাদেরই কর্তব্য। যে আশঙ্কা সব চাইতে ভাবাচ্ছে তা হল, বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় এবং সরকার— সকলে যদি সংখ্যালঘুদের হয়রানি, গণপ্রহারকে নিয়মিত মদত দিতে থাকে কেবল ভোটের জন্য, আর তার ফলে যদি সেই সম্প্রদায়ের এক শতাংশ মানুষও হাতে অস্ত্র তুলে নেন, তা হলে কী হবে? সতেরো কোটি মুসলিম জনসংখ্যার সতেরো লক্ষ হিংসার পথ বাছলে কী করে তার মোকাবিলা করা যাবে, আমরা কি কখনও ভেবেছি? আমি এতটা চাঁচাছোলা কথা বলছি, কারণ সন্ত্রাসকে প্রতিহত করা কত কঠিন তা আমি জানি। আমরা কলেজ জীবনে দেখেছি, ঠান্ডা মাথায় পুলিশকে খুন করতে। তখন কী অমানুষিক শক্তি এবং আত্মত্যাগে শান্তি ফিরেছিল, তা-ও জানি।

কিন্তু এমন একটা সম্ভাবনার কথা আমরা ভাবছি কেন? ভারতের অনেক মুসলমান হয়তো হিন্দুদের থেকে ভিন্ন (অধিকাংশই নন), কিন্তু আরব এবং অন্য রক্ষণশীলরা দাবি করেন যে এ দেশের ইসলাম অনেকটাই ‘হিন্দুস্থানি’, তাতে ‘পবিত্র’ ইসলামের ভাগ কম। সুফি সন্ত ও পিরদের নাচ-গানের মাধ্যমে আরাধনা, রঙিন উৎসব, হালাল না করেই মাংসভক্ষণ, কাফিরদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা— ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ওয়াহাবি, সালাফিদের নালিশের তালিকা অন্তহীন। আমরা যেন না ভুলি যে ভারতের ধারণা নির্মাণে মুসলিমদের অবদান অন্যদের চাইতে কম নয়। তাঁরাও স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার কষ্ট সয়েছেন, ইটের পরে ইট গেঁথে আমাদের সমন্বয়বাদী সংস্কৃতি গড়েছেন।

তৃণমূল কংগ্রেসকে উপলব্ধি করতে হবে যে, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা দিয়ে তারা নিজেদের কবর খুঁড়ছে। আজ তাদের নির্দেশে যে পুলিশ বিরোধীদের নামে ভুয়ো মামলা করছে, কাল ভোটদাতা বিপরীতে গেলে সেই পুলিশই তৃণমূল নেতাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। বিজেপি-সহ সব বিরোধীদের হয়রানি বন্ধ করলে তবেই হাজার হাজার বাম, কংগ্রেস কর্মী ঘরে ফিরতে পারবেন। যাঁরা বাধ্য হয়ে বিজেপির ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের অনেকে নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ-অনুসারী দলে ফিরতে পারেন। অসাম্প্রদায়িক দলগুলি যত ক্ষণ না একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছতে পারবে, তত দিন গেরুয়া ঢেউ অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হতে বাধ্য। মুসলিমদের, দুষ্কৃতীদের ‘বাড়াবাড়ি’র প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহিষ্ণু, এই ধারণা তাঁর বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হিজাব পরে দর্শন দেওয়ার ব্যাপারটা তিনি কমাতে পারেন, কারণ কেউ তো তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রশ্ন করছে না। এটা মুসলিমদের অবশ্যম্ভাবী দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে পারবে। বিতর্কিত পশুহত্যাকে একটু আড়াল করে চলাও রাজ্যে শুভবুদ্ধি বজায় রাখতে সহায়তা করতে পারে।

‘কাটমানি’ ফেরত দেওয়া সমস্যার আংশিক সমাধানমাত্র, কারণ মানুষ মনে করেন তৃণমূল দল যে স্থানীয় নেতাদের উপর নির্ভরশীল, তাঁদের একটা বড় অংশ তোলা তুলছেন, এবং সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি করছেন। গ্রামে গেলে কানে আসছে একশো দিনের কাজের প্রকল্প থেকে টাকা সরানোর সুসংগঠিত চক্র, দারিদ্র-নিরসনের প্রায় সব প্রকল্প থেকে চুরি, কয়লা ও বালির অবৈধ খননের দুর্নীতির কথা। আধিকারিকরা নিরুপায় হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকেন— কে সরকারের বিরোধিতা করে শহিদ হতে চান? অনেকেই ভাবছেন, কী করে এই ঝামেলা থেকে বেরোনো যায়, বিশেষত যখন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক দল বাংলার মসনদ দখল করতে মরি-বাঁচি করে টাকা ছড়াচ্ছে। তার উপর তৃণমূল দলে, হয়তো পরিকল্পিত ভাবেই, মারাত্মক গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এক একটি বিধানসভা ক্ষেত্রে অন্তত আট-দশ জন নেতা একে অন্যের প্রতি ছুরি উঁচিয়ে রয়েছেন। কেবলমাত্র ‘হাইকম্যান্ড’ শান্তি বজায় রাখছে। নানা স্তরের নির্বাচনে ভোটের কতটা কে পাবে, তার বিলিব্যবস্থা করছে।

অনেকেই মনে করছেন যে, সম্প্রতি পঞ্চায়েত ভোট প্রহসনে পরিণত হওয়ার কারণ শাসক দলের ভয়— একটিও আসন হারালে সরকারি প্রকল্প থেকে টাকা, এবং বাহুবলী নেতা-কর্মীরা সরে যেতে পারেন। এই পরিস্থিতির মধ্যে থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতে গিয়ে, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাটমানি ফেরানোর ডাক দিলেন।

গণতন্ত্র যদি ফিরিয়ে আনা যায়, তা হলে বিজেপি সব দলের ক্ষুব্ধ নেতাদের জন্য ‘তৃণমূল-বিরোধী শিবির’ হয়ে দাঁড়াবে না। বাংলাকে বাঁচানোর, ভারতকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হল—সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে যৌথ সংগ্রাম করে তোলা।

No comments on 'রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা বন্ধ না হলে এই রাজ্যের বিরাট ক্ষতি'

Leave your comment

In reply to Some User