ছেলেটি অল্পবয়সি। তালঢ্যাঙা আর রোগা। তবে কণ্ঠস্বর ভাল। ভরাট ভয়েস। তাকে দিয়ে কার্যোদ্ধার হল। এবার তিনি ছেলেটিকে একদিন ডেকে পাঠালেন।
মৃণাল সেনের ফিল্মের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল, তবে বাক্তিগতভাবে আলাপ হল ১৯৯৭ সালে। 'ক্যালকাটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল'-এর কমিটিতে আমার নাম অন্তর্ভূক্ত হওয়ার পর। সেই সুবাদে ঘনিষ্ঠ পরিচয় গড়ে ওঠে। প্রচুর আড্ডা মেরেছি ওঁর সঙ্গে। মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎ না হলে গৌতম ঘোষকে ডেকে বলতেন — তোমার আইএএস বন্ধুটির খবর কী?
মানুষটি ছিলেন সিম্পল। অলংকারহঈন। ভনিতা পছন্দ করতেন না। আবার প্রবল শিক্ষিত। নানা বিষয়ে আগ্রহ 'ছিল। তাই আড্ডা-গল্প করে আনন্দ হত।
এরকম আড্ডা মারতে মারতেই একটি আশ্চর্য সুন্দর গল্প জানতে পারি। তাই আজ 'শেয়ার' করে নিচ্ছি।
খাজা আহমেদ আব্বাস ছিলেন মৃখালদার কাছের বন্ধু। 'ভুবন সোম' মুক্তি পাচ্ছে ১৯৬৯। এটা ওই সময়ের কথা। আব্বাস সাহেব তখন 'সাত হিন্দুস্থানি' বানাচ্ছেন। তাঁর অভিযোগ, তিনি উৎপল দত্তকে চান এই সিনেমার জন্য, কিন্ত উৎপল দত্ত 'ডেট' দিতে চাইছেন না। কেন? না, সেই সময় উৎপল দত্ত শুটিং করছিলেন 'ভুবন সোম'-এর। সময় না-দেওয়ার এটিই রিজ্ন।
এর সমাধান করতেই খাজা আহমেদ আব্বাস দ্বারস্থ হলেন মৃণালদার। ওঁর বক্তব্য, তুমি একটু বুঝিয়ে বলে দাও না! তাহলেই আমার কাজ মিটে যায়। মৃণালদা সব শুনে বললেন, বেশ, তা বলে দেব। তবে আমি একটি ভাল কন্ঠস্বরের ছেলেকে খুঁজছি। তোমাকে সেই কাজটি করে দিতে হবে। আব্বাস সাহেব প্রতিশ্রুত হলেন।
এক কথায়, দু'জন পরিচালকের মধ্যে এক ধরনের মৌখিক চুক্তি হল, যার বুনিয়াদ বন্ধুত্ব।
মৃণালদা কথায় শেষ পর্যন্ত উৎপল দত্ত রাজি হযে 'ডেট' দিয়ে দেন। আর, খাজা আহমেদ আব্বাস পাঠিয়ে দেন একটি তরুণ ছেলেকে, মৃণালদার কাছে।
সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশে মৃণাল সেনকে আমরা সবসময়ই যেন কিছুটা দূরত্বে রেখে দেখতে অভ্যস্ত। এই প্রবণতা শোধিত ও সংস্কৃত হওয়া দরকার।
পরে যখন মৃণালদার মুখে গল্পটি শুনেছি, সেই সময় উনি বলেছিলেন — ছেলেটি অল্পবয়সি। তালঢ্যাঙা আর রোগা। তবে কণ্ঠস্বর ভাল। ভরাট ভয়েস। তাকে দিয়ে কার্যোদ্ধার হল। এবার তিনি ছেলেটিকে একদিন ডেকে পাঠালেন। সে এল। তখন মৃণালদা তাকে একটি 'চেক' দেন। ছেলেটি অবাক! কেন, চেক? এই কথা শুনে মৃণালদা অবাক। বললেন — বাঃ, কাজ করলে যে, পারিশ্রমিক নেবে না? ছেলেটি বলে, সে টুকটাক কাজ করেছে বটে, তবে এখনও অবধি পারিশ্রমিক পায়নি। এটি পেয়ে সে তাই অবাক এবং আপ্লুত।
এই ছেলেটি আর কেউ নন — অমিতাভ বচ্চন। সাতের দশক থেকে তাঁর স্টারডমের অশ্বমেধীয় ঘোড়া ছুটতে শুরু করবে। তিনি কালক্রমে হয়ে উঠবেন 'লিভিং লেজেন্ড', ভারতীয় সিনেমার কালজয়ী নক্ষত্র। অথচ, প্রথম পেমেন্ট পেয়েছেন মৃণালদার সিনেমায় জড়িত থেকে।
গল্পটি এত চিত্তাকর্ষক, শোনার পরে মনে হয়েছিল, এমন কত না-জানা ঘটনা, না-বলা কাহিনি হয়তো সঞ্চিত আছে মৃণালদার সিন্দুকে। সেগুলি তো উদ্ধার করা দরকার। সেই ভাবনা থেকে ২০১২ সালে 'প্রসার ভারতী'-র 'সিইও' হওয়ার পরে উদ্যোগ নিই মৃণাল সেনের ওপর একটি ডকুমেন্টারি বানানোর। যেখানে সরাসরি কথা বলবেন তিনি। এমন কাজের জন্য কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে? মৃণালদা-ই প্রথমে সাজেস্ট করেন অনন্যার (বন্দ্যোপাধ্যায়) নাম। পরে, স্ক্রিপ্ট সাজিয়ে প্রশ্নমালা রচনা করা ইত্যাদির কাজে সংযুক্ত হন শমীক বন্দ্যোপাধ্যার। ইচ্ছা ছিল, ২টি খণ্ডে সমাপ্ত করব। পরে, সেটি গিয়ে দাঁড়ায় ৪টি খণ্ডে।
এত বড় উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়েছিলাম বলে বলছি না, ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষাপটে মৃণাল সেনের মূল্যায়নের জন্যও এটি মাইলফলক কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশে মৃণাল সেনকে আমরা সবসময়ই যেন কিছুটা দূরত্বে রেখে দেখতে অভ্যস্ত। এই প্রবণতা শোধিত ও সংস্কৃত হওয়া দরকার। আর, নতুন করে ভাবনার কাজ শতবর্ষ থেকেই শুরু হোক। (কথা বলে অনুলিখিত)