ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাংলায় প্রায় ২৬০০০ শিক্ষকের চাকরি বাতিল হচ্ছে। এই রকম আঘাতের পর, বোঝাই যাচ্ছে, বাংলা আবার উত্তাল হতে চলেছে, আবার এক বা একাধিক আন্দোলন শুরু হব হব করছে। মুখ্যমন্ত্রী এটা আঁচ করে, মরিয়া হয়ে এক হাত খেললেন। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে শিক্ষকদের ডাকলেন আর চেষ্টা করলেন গরম হাওয়াটা তাঁর পালের দিকে টানতে। কিন্তু তিনি কোনও স্পষ্ট আশ্বাস তো দিতে পারেনইনি, বরং জল আরও ঘোলা করে দিলেন। উনি শিক্ষকদের স্বেচ্ছায় স্কুলে পড়াতে যাওয়ার কথা বলেছেন। এর মানে কী? তাঁরা বহাল রইলেন না বরখাস্ত হওয়ার পরে, সেই পদের কাজ কি সমাজ সেবা হিসাবে করবেন? টাকা পাবেন কি? কত? কী ভাবে পাবেন, পদস্থ শিক্ষক হিসাবে না স্বেচ্ছাসেবী হয়ে? এই সবে কিছু হবে না।

নিজের কথা বলা দরকার একটু। ২০২১-এর ভোটের ঢেউয়ে রাজ্যসভার সাংসদ পদ গ্রহণ করেছিলাম। বাংলার মানুষ তখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিপুল ভোটে জিতিয়েছিলেন। তখন এতই জনসমর্থন ছিল যে, কংগ্রেস আর বাম দলগুলি নির্মূল হয়ে গেল। অভূতপূর্ব জয়। কিন্তু তার এক বছর পরেই খবরে দেখলাম সেই গোলাপি দু’হাজার টাকার নোটের পাহাড় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির বাড়িতে। লজ্জায় এবং ক্ষোভে আমি তখনই দল ও রাজ্য সরকারকে প্রকাশ্যে বলতে বাধ্য হলাম: এই কেলেঙ্কারি এখনই সামলান, নয়তো ভীষণ ভুগতে হবে। দলের প্রৌঢ় নেতারা আমায় দল থেকে বার করার কথা বললেন, কিন্তু আমি তো কোনও দলের সদস্যই হইনি।

আমার বিশ্বাস, তখনও চেষ্টা করলে এই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসা যেত। দল আমায় বলল, এ সব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে রাজ্যসভায় মোদী সরকারকে নাজেহাল করতে। আর বাংলার হয়ে সওয়ালের তোপ চালিয়ে যেতে। আমি মানলাম, কেননা আমিও জানতাম এই জীবনে আর এ রকম সুযোগ পাব না। কিন্তু দল ও সরকারের দুর্নীতি বাড়তেই থাকল। আর আমি শেষ পর্যন্ত সেই সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হলাম।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, ওঁরা যদি ২০২২-এ আমার কথা শুনতেন আর যোগ্য-অযোগ্য ভাগ করার চেষ্টা করতেন, তবে আজ এই ভয়ানক অবস্থা হত না। এখন আন্দোলন ছাড়া আর কোনও উপায় দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হল, আন্দোলন থেকে কি কিছু লাভ হবে? এর আগের জুনিয়র ডাক্তারদের বিশাল আন্দোলন থেকে কি কিছু শিখতে পারে?

আমাদের বুঝতে হবে যে, বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা বেশ উত্তেজনাপ্রবণ। এই সরকারের আমলের ব্যাপক চুরি, দুর্নীতি আর দাদাগিরির বিরুদ্ধে রাজ্যের অনেকে— বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বা শিক্ষিত সমাজ— প্রচণ্ড বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। এই পটভূমিকায় আর জি কর হাসপাতালে অভয়ার অতি ঘৃণ্য ঘটনাটি ছিল বারুদ, আর জুনিয়র ডাক্তাররা ট্রিগারের কাজ করেছেন। তাঁরা মুহূর্তের মধ্যে সক্রিয়তা ও নিষ্ঠা দেখিয়ে নির্ভয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই দেখে সাধারণ মানুষও লাখে লাখে রাস্তায় নামলেন তাঁদের নিজেদের রাগ, ক্ষোভ আর ধিক্কার জানাতে। অগণিত লক্ষ প্রাণের এক কণ্ঠে আর্তনাদ ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। এই ইতিহাস বাংলার মানুষ সহজে ভুলবেন না।

অনেকে বলেন, এত আন্দোলন করেও অভয়ার আসল দোষীদের তো শাস্তি দিতে পারল না। আর জুনিয়র ডাক্তারদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এমন কয়েকটি চাল খেললেন যে, তাঁদের প্রতিবাদ প্রায় খতম হয়ে গেছে। আসল কথা হল, ছাত্র-রাজনীতিতে অন্য বিভাগের তুলনায় স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে ডাক্তারি ছাত্রদের অবস্থা পৃথক। তাঁরা সরকারের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল, অন্তত কেরিয়ারের গোড়ার দিকে। অতএব ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা বেশি সতর্ক থাকেন। তা ছাড়া তাঁদের পড়া আর ট্রেনিং শেষ করার দায়িত্বও তো আছে। না করলে তো পরে আমাদের সকলকেই ভুগতে হতে পারে। অতএব ডাক্তারদের পক্ষে খুব একটা লম্বা আন্দোলন চালানো যথেষ্ট কঠিন। তাও কিছুই বলা যায় না। দেখা যাক জুনিয়র ডাক্তাররা কী ঠিক করেন।

আমাদের বুঝতে হবে যে, বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা বেশ উত্তেজনাপ্রবণ। এই সরকারের আমলের ব্যাপক চুরি, দুর্নীতি আর দাদাগিরির বিরুদ্ধে রাজ্যের অনেকে— বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বা শিক্ষিত সমাজ— প্রচণ্ড বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। এই পটভূমিকায় আর জি কর হাসপাতালে অভয়ার অতি ঘৃণ্য ঘটনাটি ছিল বারুদ, আর জুনিয়র ডাক্তাররা ট্রিগারের কাজ করেছেন। তাঁরা মুহূর্তের মধ্যে সক্রিয়তা ও নিষ্ঠা দেখিয়ে নির্ভয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই দেখে সাধারণ মানুষও লাখে লাখে রাস্তায় নামলেন তাঁদের নিজেদের রাগ, ক্ষোভ আর ধিক্কার জানাতে। অগণিত লক্ষ প্রাণের এক কণ্ঠে আর্তনাদ ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। এই ইতিহাস বাংলার মানুষ সহজে ভুলবেন না।

মানুষের ঘৃণা প্রস্ফুটিত হল নতুন নতুন শব্দের আবির্ভাবে— মেরুদণ্ডহীন, চটিচাটা, থ্রেট-কালচার, ইত্যাদি। আর ক্ষোভের সবচেয়ে বড় এবং ঐতিহাসিক প্রদর্শন দেখা গেল ১৪ অগস্টের রাতে। লক্ষ লক্ষ মহিলা একত্রিত হয়ে ‘রাত দখল’ করলেন সবার কল্পনার বাইরে। গত শতাব্দীর সেই আবেগপূর্ণ ও বিদ্রোহী ষাট ও সত্তরের দশক থেকে গণ-আন্দোলন দেখেছি, তার পর অনেক রাজনৈতিক প্রতিবাদের সাক্ষী হয়েছি। কিন্তু এত স্বতঃস্ফূর্ত বিশাল দ্রোহ সত্যিই আগে দেখিনি।

কিন্তু এখন অনেকেই মনে করছেন যখন আর শোনা যাচ্ছে না সেই কোলাহলপূর্ণ ধ্বনি, অবস্থা বোধ হয় একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই ধারণাটি যে কত ভ্রান্ত আগামী কয়েক মাসেই দেখা যাবে। সাধারণ মানুষ কিন্তু এখন জাস্টিস আরও বেশি চাইছেন— শুধু অভয়ার জন্যে নয়, আর জি করের মাফিয়াদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়, এ বার জনগণ চাইছেন জাস্টিস, বর্তমান সরকারের দৃষ্টিকটু দোষগুলির মোকাবিলায়।

যাঁরা মনে করছেন অভয়া-কেন্দ্রিক ওই বিশাল আন্দোলনের যখন কোনও ফল হল না, যোগ্য শিক্ষকরা রাস্তায় নেমেই বা কী করতে পারবেন, তাঁদের বলি আশার আলো কিন্তু আছে। প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, অভয়ার মামলা সবচেয়ে প্রাথমিক স্তরে বিচারক তাঁর রায় দিয়েছেন পাঁচ মাসেই। এই দ্রুততাই অভয়ার প্রথম জয়। বিচারক একমাত্র সঞ্জয় রায়কেই দোষী সাব্যস্ত করায় আর তাকে ফাঁসির সাজা না দেওয়ায় অনেকে অসন্তুষ্ট। খুনের স্থান থেকে প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে কি হয়নি, এ বিষয়ে নীরবতা দেখে সাধারণ লোক আরও ক্ষিপ্ত। অভয়ার বাবা-মা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে আর্জি জানিয়ে বিষয়টি আবার কলকাতা হাই কোর্টে ফিরিয়ে এনেছেন। এখন মনে হচ্ছে হাই কোর্ট সিবিআই-কে বেশ চেপে ধরেছে। প্রথমেই আদালত গণধর্ষণ হয়েছে কি হয়নি, বিষয়টি তুলে সিবিআই-কে অসম্ভব অস্বস্তিতে ফেলেছে। তার পর আসছে আরও ভয়ঙ্কর প্রশ্ন: সিবিআই-কে প্রামাণিক তথ্য দেখিয়ে বিচারপতির সামনে স্থাপন করতে হবে যে, অকুস্থলের প্রমাণ লোপাট বা পরিবর্তন করা হয়েছে কি হয়নি। প্রসঙ্গত, এই অভিযোগে টালা থানার ওসিকে সিবিআই গ্রেফতার করে হেফাজতে রেখেছিল। জাস্টিসের খেলা এখনও বাকি আছে, প্রাক্তন প্রিন্সিপালের দুর্নীতির কেসও বিচার হবে। অতএব অভয়ার আন্দোলন একেবারেই নিষ্ফল নয়।

এই আন্দোলনের ধাক্কায় কয়েক দশক ধরে যে সব কাজ রাজ্য সরকার হাসপাতালে করেনি বা করতে পারেনি, তার অনেকখানি হয়ে গেছে বা হচ্ছে। সুরক্ষার ক্যামেরা থেকে বিশ্রাম ঘর আর হাসপাতালে কোনও বেড খালি আছে কি না, তা নিয়ে সকলকে অবগত করা— এই সবই তো প্রতিবাদী ডাক্তারদের জয়। আন্দোলন করে সারা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এখন ভারতের সর্বোচ্চ স্তরে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা চলছে সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নত করা যায় কী করে। সুপ্রিম কোর্টের গঠন করা টাস্ক ফোর্স নিশ্চয়ই অনেক মূল্যবান প্রস্তাব দেবে।

সবশেষে মনে রাখতে হবে, এই মহানগর আর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার প্রচুর মানুষ, যাঁদের মধ্যে শিক্ষিত শ্রেণি বেশি, তাঁরা তৃণমূলকে পছন্দ না করলেও ভোটের সময় বাংলায় সাম্প্রদায়িক শক্তি ঠেকাবার জন্য ওদেরই ভোট দিত। এ বার তা নাও হতে পারে— এটা নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাবে। শিক্ষকদের নিয়ে যে বিপাকে পড়েছে দল ও সরকার, তা দলের বিভিন্ন নেতাদের সাক্ষাৎকার থেকেই বোঝা যাচ্ছে। গত নয় মাসে আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার এক বিশাল অংশ সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এক হাতে ভর্তুকি আর এক হাতে চুরি, দুর্নীতি, তোলাবাজি, হুমকি আর দাদাগিরি— আর তারা বরদাস্ত করবে না।

No comments on 'আমরা হেরে যাইনি'

Leave your comment

In reply to Some User