প্রতিটি নির্বাচনকেই মনে হয় এযাবৎ কালের নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরত্বপূর্ণ। তাই, ২০১৯ সালের নির্বাচনও এযাবৎ কালের মধ্যে সবচেয়ে সঙ্কটপূর্ণ বলে অনুভূত হচ্ছে।
আমি ১৯৭৭ সাল থেকে নির্বাচনী কার্য পরিচালনা করেছি। সেই সময় বর্ধমানের ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার’ হিসেবে ইন্দিরা গাঁধীর নেতৃত্বের ধ্বংসপ্রাপ্তির সাক্ষী হয়েছিলাম। তখন থেকেই, আমি বিভিন্ন সরকারি পদাধিকার বলে বাংলায় এবং বাংলার বাইরে একাধিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শামিল হয়ে এসেছি এবং ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে রাজ্যে মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক হিসেবে আমার মেয়াদ শেষ হয়।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একজন উৎসাহী এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক হওয়াতে আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি যে, এই নির্বাচন অন্যান্য বারের চেয়ে সত্যিই বেশ আলাদা রকম। এটা বলছি, কারণ বর্তমানে আমার মূল দুশ্চিন্তার বিষয় হল, আমরা কি ভোটদাতাদের সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করব না যাতে তাঁরা পরবর্তী কালে, যে কোন শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের হাতে— সে কেন্দ্রেই হোক বা রাজ্যে— চিহ্নিত এবং নিগৃহীত না হন?
যদিও ব্যক্তিগত স্তরে কে কাকে ভোট দিয়েছেন সেটা জানা এখনও বেশ কঠিন, কিন্তু কোনও একটি বিশেষ রাস্তা বা এলাকা, যা কোনও একটি বিশেষ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের অধীন, তার ভোটদানের ধাঁচাটা ভাল মতোই অনুমান করা যেতে পারে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দুর্বল শ্রেণি এবং সংখ্যালঘু যাঁরা, তাঁরা নির্বাচনের পর শনাক্তকরণ এবং তাঁদের ‘কৃতকর্মের ফলভোগের’ আওতায় পড়ে যেতে পারেন। এক জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তো খোলাখুলিই ভোটদাতাদের এ বিষয়ে শাসিয়েছেন। কারণ, আমাদের বর্তমানে যা পরিস্থিতি, তাতে যে কোন পাড়া বা মহল্লায় পক্ষে বা বিপক্ষে পড়া ভোটের অঙ্ক কষে ফেলা মোটেই শক্ত নয়। এই হিসেবটা প্রতিটি পার্টি এবং প্রতিটি প্রার্থীর কাছে জরুরি।
আগেকার ব্যালট বাক্সের ভোট দেওয়ার পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইনের ৫৯এ আইনটি প্রয়োগ করতে পারতেন এবং একটি পোলিং বুথে পড়া ব্যালটগুলির বাধ্যতামূলক মিশ্রণের হুকুম দিতে পারতেন। এটা করা হত কোন এলাকার মানুষ কাকে ভোট দিয়েছেন তা জানা যাতে এক রকম অসম্ভব হয়ে যায়, সেই দিকে নজর রেখে। যখন থেকে আমরা ‘বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র’ (ইভিএম) ব্যবহার চালু করেছি তখন থেকে এই আইনি বিধানটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
আজ আমি বেশ স্মৃতিভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভাবছি, কী ভাবে ১৯৯৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনের ঠিক আগে, নির্বাচনী আধিকারিকেরা ভোটদাতাদের এই ভোট দেবার মেশিন, যা তখন একেবারে আনকোরা জিনিস, তাঁদের কাছে সে সম্পর্কে অক্লান্ত ভাবে প্রচারকার্য চালিয়ে যেতেন। আজকাল প্রতিটি ইভিএম শুধু তার নিজস্ব পোলিং বুথের ফলাফল দেখিয়ে দেয়। এই রকম অনেকগুলি বৈদ্যুতিন যন্ত্রের ফলাফল কিন্তু আর মিশিয়ে ফেলা যায় না যেমন আগে কাগজের ব্যালটের ক্ষেত্রে হত।
যাই হোক, নির্বাচনী আয়োগ কঠোর পরিশ্রম করে এবং ইভিএম নির্মাতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ‘টোটালাইজার’ নামক একটা নতুন মেশিন তৈরি করে, যেটা চোদ্দোটি পোলিং বুথের যন্ত্রে দেওয়া ভোটগুলিকে যোগ করতে এবং মিশিয়ে ফেলতে সক্ষম। এটা অবশ্যই এক বিরাট সাফল্য এবং ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে কমিশান আইন মন্ত্রককে ‘টোটালাইজার’ যন্ত্রটির ব্যবহার এবং সেই সংক্রান্ত আইন সংশোধন করতে অনুরোধ করে চিঠি লেখে, যাতে অন্তত ঐচ্ছিক রূপে হলেও এটি ব্যবহার হয়। মন্ত্রক অনুরোধটিকে সংসদীয় কমিটিতে পাঠিয়ে দেয় যারা বেশ কয়েক বছর এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, হয়তো রাজনৈতিক দলগুলি সব সময়ই বুথভিত্তিক বা এলাকাভিত্তিক ফলাফল জানতেই উৎসুক থাকে বলে। ২০১০ সালে আইন মন্ত্রক কমিশনের এই সুপারিশ একটি পলিসি নোট-এর মাধ্যমে অনুমোদন করেন এবং যে নিষ্ক্রিয়তা এর পরে দেখা যায় তাকে বলা যায় আগেকার সরকারের অজস্র ভুলের মধ্যে আর একটি। কারণ আপাতদৃষ্টিতে সর্বগ্রাসী বা আগ্রাসনপ্রবণতার ভয় আগে এতটা ছিল না, যা এখন হয়েছে।
নাটকীয় ঘটনাস্রোতে ফিরে এলে দেখব, ২০১৪ সালে নির্বাচন কমিশন তাদের কর্তব্য হিসেবে সরকারি মন্ত্রককে ‘টোটালাইজার’ ব্যবহার করে ভোটদাতাদের পরিচয় গোপন রাখার একান্ত প্রয়োজনের কথা আর একবার মনে করিয়ে দিয়েছিল। এটা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহার হবে যখন কমিশন কোনও নির্বাচনী ক্ষেত্রকে বা তার কোন অংশকে সংবেদনশীল বলে মনে করবেন। ২০১৪ সালে, সুপ্রিম কোর্টও এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে এবং জানতে চায় যে কেন মন্ত্রক এই আইনটি সংশোধন করতে জরুরি ব্যবস্থাভিত্তিক পদক্ষেপ করছে না। মন্ত্রক উত্তর দেয়, যে তারা আইন কমিশনের কাছে প্রস্তাবটি পাঠিয়েছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, আইন কমিশন পরিষ্কার ভাবে অনুমোদন করা সত্ত্বেও, যা তাদের মার্চ ২০০৫-এর রিপোর্ট ‘নির্বাচনী সংশোধন কার্যসমূহ’-এর ১৩.৭ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত আছে, যে নির্বাচনী নিয়মকানুনগুলি সংশোধন করে ‘টোটালাইজার’এর ব্যবহার চালু করতে হবে, দেশের বর্তমান সরকার কিন্তু তা করেনি। এটা যথেষ্ট পরিষ্কার যে রাজনৈতিক শ্রেণির একটা অংশ কোন কোন বুথে তাদের পক্ষে ভোট পড়েছে আর কোন কোন বুথে পড়েনি সেটা জানতে তারা খুবই উদ্গ্রীব।
এই সরকারের কাজের বিবরণী ঘাঁটলে দেখব যে এরা কত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এবং শল্য চিকিৎসকের নিপুণতায় সংখ্যালঘু আর দলিতদের আক্রমণ করেছে। তাতে আমরা শুধু ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করতে পারি যে তিনি যেন ভারতবর্ষে এ বারের নির্বাচনের জের টেনে পরবর্তী কালে যাতে অবাঞ্ছিত কিছু না ঘটে, সেদিকে নজর রাখেন।
সেই সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে ভারতবর্ষের মানুষ এমন সব সংশয়ের মধ্যে দিয়ে অতীতেও গিয়েছে এবং মন যাদের তৈরি সেই জনগণকে কোন ভয় দেখিয়েই নিবৃত্ত করা যাবে না—তাঁরা কাকে ভোট দেবেন সে বিষয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিশ্চয় তাঁরা নিজেরাই নেবেন।