নাগরিকত্বের প্রশ্নে দেশের বহু অঞ্চলে যে আকস্মিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেটা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রথম বড় মাপের সামগ্রিক আন্দোলন। সাড়ে পাঁচ বছর ধরে দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্র নীরবে দেখেছে, কর্তৃত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িকতার আধিপত্য কী ভাবে উত্তরোত্তর জোরদার হয়েছে। কিন্তু এ বার যেন সে আপন কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছে। ভারতের মানুষ দিনের পর দিন দেখেছেন, এক দিকে জনপরিসরের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিক ভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, স্বাধিকার এবং ন্যায়ের কাঠামো ক্রমাগত বিধ্বস্ত হচ্ছে, অন্য দিকে কংগ্রেস নিজের মৃত্যুকামনায় একনিষ্ঠ, বামপন্থীরা ধূলিসাৎ, অন্য নানা বিবর্ণ বিরোধী দল দিশাহারা। তাঁরা আজ হঠাৎ এই স্বতঃস্ফূর্ত ক্রোধের ভুবনে জেগে উঠেছেন। এমনকি যে সংবাদমাধ্যমগুলি শাসকের প্রতি সমাজের সমর্থন আদায়ের অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, তারাও এই পরিবর্তনকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে।
অনেকেই মনে করেন, সাম্প্রতিক বিক্ষোভের ভিত যথেষ্ট প্রসারিত নয়, ছাত্রছাত্রীরাই আন্দোলন চালাচ্ছে, বিক্ষোভ কিছু শহরের, প্রধানত মধ্যবিত্ত বর্গের বাইরে যেতে পারেনি, বহুলাংশে এর শক্তি জুগিয়েছে একটি সম্প্রদায়। প্রসঙ্গত, ১৯৭৪-৭৫ সালে ভারতে দু’টি গণজাগরণ হয়েছিল, গুজরাতের নবনির্মাণ আন্দোলন ও বিহারে জয়প্রকাশ নারায়ণের সম্পূর্ণ ক্রান্তি। সেই আন্দোলন দু’টি দানা বেঁধে ওঠার পিছনেও প্রধান ভূমিকা ছিল তরুণদের, পরে মোরারজি দেশাই বা জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো বয়োজ্যেষ্ঠরা তার হাল ধরেন। সত্যি বলতে কি, ২০১৯-এর মে মাসে মোদী-শাহের ব্যাটারি রিচার্জ হওয়ার পরেই তাঁরা প্রবল পরাক্রমে অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। তাকে রুখে দিতে যে বেপরোয়া সাহসের দরকার হয়, তার জন্য এই দলহীন, নেতৃহীন যুবশক্তির এগিয়ে আসা খুব দরকারি ছিল।
মোদী জমানার দ্বিতীয় পর্বের প্রথম পাঁচ মাসে ভারতের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর, বিশেষত দ্বিতীয়টির ওপর যতটা আক্রমণ নেমে এসেছে, সেটা আগে কখনও হয়নি। সংসদের গত দু’টি অধিবেশনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিয়ে যা করা হয়েছে, তাকে পরিহাস বললে ভুল হয় না। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এবং রাজ্যসভায় নানা কৌশল করে প্রচণ্ড বেগে তিন তালাক নিষেধ আইন থেকে শুরু করে একের পর এক বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হল। আইনের পর আইন সংশোধন চলল— নাগরিক অধিকার দমন করা হল নানা ভাবে, এনআইএ-র ক্ষমতা বাড়ানো হল, ইউএপিএ’কে আরও কঠোর করে কারণ না দেখিয়েই আটক করার অধিকার দেওয়া হল প্রশাসনকে, তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত আইনকে দুর্বল করে তোলা হল। অন্য দিকে, মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সংক্রান্ত আইনে ঢুকল বিপজ্জনক শর্ত। আধার কার্ড নামক নজরদারির প্রকরণটিকে অনেক বেশি জোরদার করা হল।
কিন্তু ভারতের গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের ওপর অকল্পনীয় আঘাত নেমে এল ৫ অগস্ট, যখন জম্মু ও কাশ্মীরের যেটুকু নাম-কা-ওয়াস্তে স্বাধিকার ছিল, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের হুকুম জারি করে সেটুকুও হরণ করা হল নিরাবরণ উল্লাসে। অভূতপূর্ব সংখ্যায় নিরাপত্তা বাহিনীর উর্দিধারীদের উপত্যকায় পাঠানো হল, যাতে কাশ্মীরের মানুষ প্রতিবাদ জানানোর সাহস না পান। অন্য দিকে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অস্ত্র হিসেবে চলল আয়কর বিভাগের হানাদারি এবং সিবিআইয়ের অভিযান। ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও এক মুখ্যমন্ত্রীকে দীর্ঘ দিন আটক রাখা হল। এই সমস্ত ব্যাপারই একটা জিনিস নিশ্চিত করেছিল: ভারতের নতুন শাহকে কেউ যেন চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস না পায়।
দেশ এই আঘাত সামলে ওঠার আগেই এল আর এক আক্রমণ। ৩১ অগস্ট প্রকাশিত হল অসমের জন্য প্রস্তুত জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)। অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার এই অতি জটিল উদ্যোগটির তদারকি করে আসছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু যখন দেখা গেল, নাগরিক পঞ্জি থেকে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে, যাঁদের অধিকাংশই হিন্দু, ফেনিয়ে উঠল ব্যাপক অসন্তোষ। যাঁরা ভাবছিলেন, এনআরসি দিয়ে ‘বাংলাদেশি মুসলিম’দের ধরে ফেলবেন, তাঁরা দেখে হতাশ হলেন যে, সেই উদ্দেশ্য বিশেষ সাধিত হয়নি। অন্য দিকে, যাঁদের নাম বাদ পড়ল, তাঁরা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন, বিশেষ করে যখন তাঁরা জানলেন যে অ-নাগরিকদের আটক করে রাখার জন্য শিবির তৈরি হচ্ছে, যে শিবিরকে তাঁরা দেখলেন নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নতুন অবতার হিসেবেই। অসমে আগুন জ্বলল।
কাহিনির পরবর্তী অধ্যায়ে যাওয়ার আগে মনে করে নেওয়া দরকার, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের সাংবিধানিক বৈধতা যাচাইয়ের কাজ ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিলেও অযোধ্যায় বিতর্কিত রামমন্দির সংক্রান্ত মামলাটির দ্রুত ফয়সালার জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ তৎপর হয়। ৯ নভেম্বর আদালতের রায়ে বিতর্কিত জমি হিন্দুদের হাতে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা হল। ফলে ১৯৯২-৯৩ এবং ২০০২ সালের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের হিংস্র হয়ে ওঠার ঘটনা ঘটল না, কিন্তু আটকানো গেল না অসন্তোষের গুঞ্জন। মন্দির এবং মসজিদের জমির বন্দোবস্ত যে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হল, ২৭ বছর আগে যারা সকলের চোখের সামনে একটি ধর্মস্থান ধ্বংস করেছিল, সমান দ্রুততায় যদি তাদের বিচারের ব্যবস্থা হত, তা হলে বহু মানুষের অসন্তোষ ও ক্ষোভ হয়তো অনেকটা কম হত।
চরম আঘাতটা এল ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, যখন ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বলে দেওয়া হল, প্রতিবেশী তিনটি দেশের সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্বের আবেদন সহৃদয় ভাবে দেখা হবে, কেবল মুসলমানেরা এই সুযোগ পাবেন না। হিসেব করে অন্য চারটি প্রতিবেশী দেশকে এই আইনের এক্তিয়ারের বাইরে রাখা হল। এই আইন সংশোধনের পরেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাবে বার বার প্রতিশ্রুতি তথা হুমকি দিতে শুরু করলেন যে গোটা দেশে এনআরসি প্রবর্তন করা হবে, সেটাই অবশেষে বিস্ফোরণ ঘটাল। এখানে বোঝা দরকার, দেশের নানা জায়গায় যে প্রবল বিক্ষোভ আন্দোলন হচ্ছে, তার কারণগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম। অসমে এনআরসি থেকে বাদ পড়া বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়ার উদ্যোগে সে রাজ্যে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তামিলনাড়ুতে বিক্ষোভের প্রধান কারণ, বিজেপির এই বড়দিনের উপহারটি থেকে শ্রীলঙ্কার তামিল শরণার্থীরা বঞ্চিত হয়েছেন। তবে তার পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেও সে রাজ্যে অনেকেরই আপত্তি আছে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল বিজেপির এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে বড় আকারের প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করেছে, তাদের একটা বড় লক্ষ্য অবশ্য সংখ্যালঘু সমাজে দলের সমর্থনের ভিতটাকে আরও জোরদার করে তোলা। আবার, সরকারি আধিকারিকদের উপদ্রব, দুর্নীতি ও হৃদয়হীনতা ইত্যাদি কারণে এনআরসি বহু লোকের মনে যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদের পিছনে তারও একটা গুরুতর ভূমিকা আছে। এটা ঠিকই যে, দেশের অন্য বেশ কিছু অঞ্চলে বিক্ষোভ প্রথমে শুরু করেছিলেন মুসলমানেরাই— নাগরিকত্বের প্রশ্নে বৈষম্যের জন্যই নয়, যে ভাবে তাঁদের হিসেব কষে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে রাখা হয়েছে, সুপরিকল্পিত ভাবে তাঁদের ক্ষমতা অর্জন করতে দেওয়া হয়নি, তার প্রতিবাদও এই বিক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, হিন্দুরা এবং অন্যরাও, বিশেষত তরুণতরুণীরা দেখতে দেখতে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন, অনেক জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একটা অন্য দ্বন্দ্বও প্রকট হয়েছে। মনে রাখতে হবে, ১৯৪৭-৪৮ সালে সঙ্ঘ পরিবার জাতীয় পতাকার বিরোধিতা করেছিল, অমর্যাদাও। শেষে সর্দার পটেলের চাপে তারা ওই পতাকা মেনে নিতে বাধ্য হয়। অধুনা তারাই অতিমাত্রায় জাতীয়তাবাদী সাজছে, জাতীয় পতাকার আদর্শগত নেতৃত্ব দাবি করছে। কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদীরা সেই দাবি প্রতিহত করতে এগিয়ে এসেছেন। ছাত্রছাত্রীরা নানান গাঁধীগিরিও দেখিয়েছেন, যেমন পুলিশকে গোলাপ ফুল এগিয়ে দিয়ে মন জয় করার বা লজ্জায় ফেলার চেষ্টা। তবে ২০১২-১৩’য় নির্ভয়া সংক্রান্ত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, দিল্লি কী ভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। আবার অন্না হজারের ডাকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে কী ভাবে তরুণতরুণীরা রাজধানী-সহ দেশের নানা শহরকে বিক্ষোভে আন্দোলনে অচল করে দিয়েছিল, তা-ও আমাদের দেখা। গাঁধী টুপিকে তারা নতুন জীবন দিয়েছিল। কিন্তু তাদের আত্মত্যাগের নেট ফল কী হল? কৌশলী অরবিন্দ কেজরীবাল এবং প্রচারলোভী কিরণ বেদীর মতো লোকেরা ক্ষমতা দখল করলেন।
কিন্তু একটা টলমলে লিবারাল-সেকিউলার সরকারকে আক্রমণ করা আর ক্ষমতামদমত্ত, নির্মম এবং দুর্বার আধিপত্যবাদীদের মহড়া নেওয়া এক নয়! এই জনবিক্ষোভের আয়ু কত দিন, কেউ জানে না। মোদী-শাহ যুগল কী ভাবে প্রত্যাঘাত করবেন সেটাও আমাদের অজানা। একটা আশঙ্কা অনেকের মনেই আছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা। যে প্রতিবাদ আমরা দেখছি, তাকে কোনও ভাবেই মুসলিমদের প্রতিবাদ বলে তকমা দেওয়া চলে না। দেখতে দেখতে সেটা সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রধানত তরুণ ভারতের আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। তরুণতরুণীরা দেখছেন, এই শাসকরা অর্থনীতির পরিচালনায় ব্যর্থ, আয়বৃদ্ধির গতিভঙ্গ হয়েছে, বেড়ে চলেছে বেকার সমস্যা। শেষ বিচারে, আমরা উপলব্ধি করছি, ভারত কোনও চূড়ান্ত প্রতিমা নয়, ভারত একটি চলমান প্রক্রিয়া। এবং, আমরা জানি, ভারতে একটি ধারণারই স্থান আছে। সেটি হল বহুত্বের ধারণা।