উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, গোয়া, পাঞ্জাব, মণিপুর, এই পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফলাফল দেখে বোঝাই যাচ্ছে বিজেপিকে হারাতে গেলে আরও অনেক বেশি প্রস্তুতি চাই।
মণিপুরে কংগ্রেস কোন প্রতিদ্বন্দিতাই দিতে পারেনি।পাঞ্জাবে কংগ্রেস সুইসাইড করল। এখানে ক্যাপ্টেন অরমিন্দর সিংকে আর অন্যান্য বালিস্ট নেতাদের নিয়ে খেলার ফলে কংগ্রেস দল বিভক্ত হয়ে গেল এবং মানুষ বিজেপিকেও ভোট না দিয়ে আম আদমি পার্টিকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করলেন।
গোয়াতেও বিজেপি জিতল, তার কারণ কংগ্রেসের নিষ্ক্রিয়তা। তৃণমূল কংগ্রেস মাত্র তিন মাস আগে গিয়ে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এত অল্পসময়ে সব কিছু করা তো সহজ নয়। দুঃখের কথা, গোয়ায় বিজেপির বিরুদ্ধে কোস্টাল রেগুলেশন নিয়ে নানান অভিযোগ ছিল, তারপরেও কংগ্রেস সেগুলোকে কাজে লাগাতে পারল না।
উত্তরাখন্ডে বিজেপি আর কংগ্রেস ছাড়া এই ভোট যুদ্ধে কেউ ছিলনা। একাধিক কারণে বিজেপির পরাজয় এখানে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখলাম, কংগ্রেসই একমাত্র দল যারা অনেক ক্ষেত্র বিজেপিকে নিশ্চিত হার থেকে বাঁচাল। তাঁরা এমন প্রস্তুতি নিলেন, এমন ব্যবস্থাপনা সাজালেন যে পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে চারটিতে বিজেপি ই জিতে গেল।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনকে সারা দেশ ধরে নিয়েছিল ২০২৪-এর সেমিফাইনাল ম্যাচ হিসেবে। এক্ষেত্রে মনে হয়, সমাজবাদী পার্টি নিজেকে আরেকটু বেশি প্রস্তুতি হয়তো নিতে পারত। গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দেখা গেল, সমাজবাদী পার্টি পুরোপুরি মাঠে নাবে। গতবছর থেকে সুশীল সমাজ, আর সাম্প্রদায়িক বিরোধী রাজনৈতিক দলেরা, অনেকেই মনে করছিলেন ওখানে বোধহয় অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীদের সাথে টানতে পারলে আরও ভাল হত। মনে হয় আরো বৃহত্তর যৌথ ফ্রন্ট করলে লড়াই টি আরো ছড়িয়ে দেওয়া যেত। যেখানে তারা মজবুত ছিল সেখানে সমাজবাদী পার্টি যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দেখিয়েছে। সমাজবাদী পার্টি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেয়েছেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
কিন্তু এই সমর্থনকে ইভিএম-এ টেনে নিয়ে গিয়ে ভোটে পরিণত করতে হলে নানান ব্যবস্থা রাখতে হয়। যা এই রাজ্যে তৃণমূলের দলনেত্রী দেখিয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন যে সব সময় ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হবেই, এই ধারণা যে ঠিক নয় তা উত্তর প্রদেশের ভোটে প্রমাণিত। এখানে স্মর্তব্য, বাংলায় নির্বাচনের প্রাক্কালে মোদী-শাহের সভা দেখে বিজেপির মনে হয়েছিল ওঁদের মানুষ সমর্থন করছেন। ব্যাপারটা অন্তত সেরকমভাবেই পরিবেশিত হয়েছিল। রাজনৈতিক সভাতে বহু মানুষ যান নেতাকে দেখতে, শুনতে। তার মানে জনসভার ভিড়ের সবাই যে ওই নেতাদের ভোট দেবেন, তা মোটেও নয়। অখিলেশ যাদব হয়তো নির্বাচনে প্রশাসন এবং ইভিএম এর মারপ্যাঁচ সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারেননি।
নির্বাচন শেষ হওয়ার পর, বেনারসে এক ট্রাক ইভিএম পাওয়া গিয়েছে। সেটা নাকি ট্রেনিংয়ে যাচ্ছিল! আমি তো পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করেছি। আমি কোনওদিন শুনিনি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর ইভিএম নিয়ে ট্রেনিং হয়! এই ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে, সন্দেহজনক। তৃণমূল কংগ্রেস পূর্ণ সমর্থন অখিলেশ যাদবকে দিয়েছে। জননেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় তাঁর হয়ে দু’বার প্রচার করেছেন। কিন্তু অখিলেশের বিজেপি বিরোধী ভোট কাটতে কংগ্রেসের কোনও ভ্রক্ষেপ হয় নি । কারণ, কংগ্রেস সেই পুরনো জমিদারের অহংকার কিছুতেই ছাড়তে নি। কয়েকটা ন্যাশনাল মিডিয়া প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে কভার করল আর তাঁরা ভেবে নিলেন তাঁরা বিশাল শক্তিশালী। শেষ মুহূর্তে প্রিয়াঙ্কা গান্ধি গিয়ে একেবারে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে নকল করে ৪০শতাংশ মহিলা প্রার্থী দিয়ে একটা স্ট্রাটেজি নিলেন। কিন্তু সারা বছর মানুষের সাথে গ্রামস্তরে কাজ না করে তাদের সমর্থন অর্জন করা যায় না।কংগ্রেসের বেশ কয়েক দিন ধরে কর্মকর্তারা অনেকদিন ধরে হতাশ হয়ে বসে ছিলেন। ক্রমাগত অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়ছিল। এতদিন ধরে কংগ্রেস নিজের হক ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও পদক্ষেপ করেনি। ১৩৭ বছরের পুরনো একটি বিশাল রাজনৈতিক দল পরিচালকদের অহংকার আর কূপমন্ডুকতার কারণে শেষ হয়ে গেল। প্রতি পদক্ষেপে আত্মঘাতী মনোভাব এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলে প্রকট। আমার বিশ্বাস, কংগ্রেস যদি সমাজবাদী পার্টির সাথে হাত মেলাতো তার একটা প্রতীকী তাৎপর্য থাকত। আসলে সমাজবাদী পার্টি বা অন্যান্য শরিকি দলরা বুঝতে পারছিল কংগ্রেস একেবারে ঠুঁটো জগন্নাথ। তাল পাতার সেপাই। একে নেওয়াও যা না নেওয়াও তাই। এর একটি প্রধান কারণ হল, লালুপ্রসাদের আরজেডি যখন কংগ্রেসের সাথে গাটঁছড়া বেঁধেছিল তখন অন্যান্য শরিকিদল নিজ নিজ আসনে ভালো ফল করলেও কংগ্রেস প্রায় সবকটি আসনে হেরে গিয়েছিল। এখানে যেমন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বামপন্থীদের যাঁরা বিশ্বাস করতো তাঁরা বামেদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, ওখানে কংগ্রেসেরও তাই হয়েছে। বাংলায় মানুষ বুঝেছিল বামেদের ভোট দিলে কাজের কাজ কিছু হবে না, শুধু ভোটটাই দেওয়া হবে। পঞ্জাব, উত্তর প্রদেশেও মানুষ তাই ভেবেছেন। মানুষের এই চেতনাকেই গুরুত্ব দিতে হবে, বুঝতে হবে।
মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ কত বৈচিত্রপূর্ণ তা ধরা পড়েছে পাঞ্জাবে আপের জয় এবং উত্তর প্রদেশে পরাজয়ের দুটি বিপরীতমুখী ছবির মধ্যে দিয়ে। পাঞ্জাবে কংগ্রেস নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গিয়ে নিজেরাই লড়াই করলেন এবং ভবিষ্যতের কোন দিশা সাধারণ মানুষকে দেখাতে ব্যর্থ হলেন। আপ প্রায় ২০১৩ সাল থেকে পাঞ্জাবে কাজ করছেন। সেখানকার মানুষ কিছুটা বাংলার মানুষের ধাঁচেই কংগ্রেসকে ভোট দিলেন না যেমন বিজেপিকেও ‘না’ বললেন। এবং আপ এর উপর ভরসা করলেন।
উত্তরপ্রদেশে দুঃখজনক ব্যাপার হল, এখানকার মানুষ এখনও ধর্মের টোপ খায়। কিন্তু এবার যে সরকারি সন্ত্রাস নেমে আসবে তার আঁচ মোদিজীর ভাষণেই স্পষ্ট। তবে ২০২৪-এ যে একই ছবির পুনরাবৃত্তি ঘটাবে তা বলা যায় না। হ্যারল্ড উইলসন বলেছিলেন, One week is a long time in politics. সেই কথার রেশ টেনেই বলব, দুবছর রাজনীতিতে অনেকটা সময়।
তবে কংগ্রেস ভারতীয় রাজনীতিতে আজকে বোঝা ছাড়া কিছুই নয়। কংগ্রেস সেটা যদি বোঝে ভালো নইলে কংগ্রেসীদের এটা সময়, এবার এখান থেকে বেড়িয়ে এসে বিজেপি-বিরোধী শক্তিদের হাত শক্ত করা, ২০২৪-এর লক্ষ্যে।