সাহিত্য ও ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ নর্মা গুডরিচ লিখেছেন, প্রাচীন স্যাক্সন কবিরা ইয়োস্ত্রে-র সঙ্গে ভারতীয় দেবী কালিকার সাদৃশ্য লক্ষ করেছিলেন: উভয় ক্ষেত্রেই জীবন ও মৃত্যুর চক্রাকার আবর্তন তাঁদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
একটা প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে: খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দিনকে ‘গুড ফ্রাইডে’ কেন বলা হয়? এমন যন্ত্রণাদায়ক অবসানের মধ্যে ‘শুভ’টা কী? বস্তুত, জার্মানিতে এবং অন্য কোথাও কোথাও খ্রিস্টধর্মের কিছু ধারায় এই দিনটির নাম ‘বেদনাময় শুক্রবার’। ইংরেজি নামটির একটি ব্যাখ্যা হল, এটি ‘গড’স ফ্রাইডে’র পরিবর্তিত রূপ। আবার, পবিত্র (‘হোলি’ বা ‘পায়াস’) অর্থে প্রাচীন ইংরেজিতে ‘গুড’ শব্দটি ব্যবহৃত হত, নামটা সেখান থেকেও এসে থাকতে পারে। এটিই ইস্টার পরবের প্রধান দিন। এই পর্বটি শেষ হয় ইস্টার সানডে’তে, যিশুর পুনরুত্থানে। ইস্টারের দিনক্ষণ নিয়ে এক কালে নানা মত ছিল, গোড়ায় ‘স্প্রিং ইকুইনক্স’ বা মহাবিষুব-এর সময় এই উত্সব পালন করা হত। মনে রাখতে হবে, খ্রিস্টধর্মের আদি পর্বের ইতিহাসে বিস্তর লোককাহিনি ও উপকথার ভিড়। প্রথমে ধরা হয়েছিল, যিশু ৩৩ খ্রিস্টাব্দে ক্রুশবিদ্ধ হন, তখন গুড ফ্রাইডে পালন করা হত ৩ এপ্রিল, অর্থাত্ আজকের তারিখটিতেই। স্যর আইজাক নিউটন গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি মেপে সময়টাকে ৩৪ খ্রিস্টাব্দে নিয়ে আসেন। এখন পশ্চিম ইউরোপের চার্চগুলি এই দিন স্থির করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে, আর পূর্ব ইউরোপে অনুসরণ করা হয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। দিনটা আলাদা হলেও এই পরবের বিশেষ প্রার্থনা এবং ‘মাস’ দুই ভূখণ্ডেই এক রকম। প্রকৃতপক্ষে, ইস্টার সানডের চল্লিশ দিন আগে শুরু হয় ‘লেন্ট’ পর্ব, অনেকে এই সময়টা উপবাস করেন।
লৌকিক উত্সব হিসেবে ইস্টার চলে আসছে খ্রিস্টজন্মের অনেক আগে থেকে। আদিতে এটি ছিল এক ‘পেগান’ দেবীর আরাধনা, তাঁর নাম ইয়োস্ত্রে বা ওস্তারা, অথবা অ্যাস্টেয়ার। বসন্তের শুরুতে তিনি পূজিত হতেন, মনে করা হত তাঁর মধ্য দিয়েই শীতের মৃত্যুশয্যা থেকে জীবনের পুনরুত্থান ঘটে। সাহিত্য ও ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ নর্মা গুডরিচ লিখেছেন, প্রাচীন স্যাক্সন কবিরা ইয়োস্ত্রে-র সঙ্গে ভারতীয় দেবী কালিকার সাদৃশ্য লক্ষ করেছিলেন: উভয় ক্ষেত্রেই জীবন ও মৃত্যুর চক্রাকার আবর্তন তাঁদের দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘ইস্টার বানি’ও খ্রিস্টধর্মের চেয়ে পুরনো, সে ছিল ইয়োস্ত্রের বাহন, তাকে মুন-হেয়ার বলে ডাকা হত। চাঁদের আর এক নাম শশধর বইকী! জার্মানদের বিশ্বাস ছিল, যে শিশুরা ভাল, ইস্টারের পূর্বলগ্নে এই অপার্থিব খরগোশ এসে তাদের জন্য সোনার ডিম রেখে যায়। হোমার স্মিথ-এর মতো পণ্ডিতদের ধারণা, মধ্যযুগের শেষ দিকের আগে অবধি ‘ইস্টার’ নামটাই চালু ছিল না। আয়ার্ল্যান্ডের মতো কোথাও কোথাও আদি ‘ইয়োস্ত্রের উত্সব’-এর দিনক্ষণ মেনে ইস্টার পালন করা হত; পরে, ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে তাদেরও রোমান ক্যালেন্ডারের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
ডিম সতত পুনর্জন্মের প্রতীক। ইস্টারের জন্য ডিমের রং যে লাল করা হয়, সেটা খ্রিস্টের রক্তের রূপক হিসেবে। রাশিয়াতে সমাধির উপর রাখা হত রক্তবর্ণ ‘ইস্টার এগ’: পুনরুত্থানের প্রতীক। চেক প্রজাতন্ত্রে ইস্টার সানডেতে খ্রিস্টকে যথাবিহিত ভাবে স্মরণ করা হত, কিন্তু ইস্টার মানডে ছিল খ্রিস্টধর্মের ‘পেগান’ প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য নির্ধারিত: সান-ডে’র বদলে ‘মুন-ডে’। ষোড়শ শতকে ইস্টারের একটি অদ্ভুত প্রথা চালু ছিল, ‘ডিম এবং আপেল নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ক্রুশকাঠের দিকে এগিয়ে যাওয়া’। এই রূপকটি এসেছে জন্ম এবং মৃত্যুর প্রাচীন স্ত্রী-আচার থেকে। আজকাল সচরাচর ডিমের আকারে চকলেট, কিংবা জেলি-বিন বা অন্য কোনও মিষ্টি ভিতরে রাখা প্লাস্টিকের ডিম ব্যবহার করা হয়, তবে অনেকেই এখনও মুরগির ডিম কড়া সেদ্ধ করে রং করে থাকেন। পোল্যান্ডে এবং পূর্ব ইউরোপের স্লাভ জনগোষ্ঠীর সমাজে খুব উজ্জ্বল রঙে এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নকশায় চিত্রিত ডিম নতুন জীবনের অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রতীক, এ জন্য অনেক জায়গাতেই পিসাংকা নামে বাটিক-এর মতো একটি শৈলী ব্যবহার করা হয়। বালগেরিয়াতে ‘ডিমের লড়াই’ এক অতি জনপ্রিয় ঐতিহ্য, বিজয়ী ডিমটিকে বোরাক শিরোপা দওয়া হয়, বোরাক মানে যোদ্ধা। জার্মান এবং সুইসরা গাছের ডালে বা ঝোপের মধ্যে নানা রঙে চিত্রিত ডিম ঝোলায়। রাশিয়ার রাজদরবারে অলঙ্করণের জন্য অপূর্ব সব মণিরত্নখচিত ডিম ব্যবহার করেছিল প্রসিদ্ধ হাউস অব েফ্যবার্জে, তার মাধ্যমে এই লোকশিল্পটি এক নতুন সম্মানের শিখরে পৌঁছেছিল।
ক্রিসমাসের মতোই ইস্টারের বিভিন্ন ধারাতেও খ্রিস্টধর্মের নানা বিবর্তনের, বিশেষত প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের প্রভাব পড়ে। প্রেসবিটারিয়ান পিউরিটানদের মতো কোনও কোনও শাখা এই উত্সবকে খ্রিস্টধর্ম-বিরোধী কুসংস্কার মনে করলেও অধিকাংশ ধারাতেই প্রাচীন প্রথার অধিকাংশই বজায় রাখা হয়। আর এখন তো ক্রিসমাসের মতোই ইস্টার মানে বিরাট বাজার, সেটা দোকানে দোকানে স্তূপীকৃত জেলিবিন, চকলেট-ডিম, মার্শমেলো-মুরগি আর ‘ইস্টার বানি’ দেখলেই টের পাওয়া যায়। বিভিন্ন লোকাচার, পেগান ঐতিহ্য এবং আধুনিক জনপ্রিয় প্রথাকে এই পবিত্র দিনটিতে ধর্ম ও ধর্মাচরণের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন সংস্কৃতিতে যেমন সান্টা ক্লস, প্রায় সে রকম ভাবেই ইস্টার বানি এক জনপ্রিয় উপহার হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। ইস্টার মানডে’তে হোয়াইট হাউসের লনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইস্টার এগ গড়িয়ে দেওয়ার একটি খেলার আয়োজন করেন, শিশুরা তুমুল উত্সাহে সেই উত্সবে যোগ দেয়।
খ্রিস্টকে যে তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল, ইস্টার তার ধারাও বহন করে চলেছে ‘প্যাশন’-এর মধ্য দিয়ে। খ্রিস্টের শেষ যাত্রা স্মরণ করে ফিলিপিন্স এবং মেক্সিকোয় মানুষ ভারী ক্রুশকাঠ বহন করে নিয়ে যান এবং নিজেদের বেত্রাঘাত করে চলেন যতক্ষণ না রক্তপাত ঘটে। অনেকে মাথায় কাঁটার মুকুটও পরেন।
বার্মুডায় ইস্টারের সময় ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হয়, যাজকরা বলেন, এই উত্সবের মধ্য দিয়ে খ্রিস্টের স্বর্গারোহণের উদ্ যাপন হয়। এই সময় ওখানে ফিশ কেক খাওয়ার খুব ধুম আছে। বাঙালির দারুণ লাগত। জামাইকাতে গুড ফ্রাইডের দিন থেকে ঘরে ঘরে প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় কিসমিস দেওয়া কেক তৈরি করা, সেই কেকের মাথায় ছুরি দিয়ে একটা কাটাকুটি করলেই জন্ম নেয় প্রসিদ্ধ ‘হট ক্রস বান’। পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে এই সময় পোতিকা নামে এক বিশেষ বাদাম-কেক বানানো হয়, আবার পোল্যান্ডে তৈরি হয় অতি উত্কৃষ্ট সাদা সসেজ।
কিন্তু ইস্টার মানে কেবল খানাপিনা আর হুল্লোড় নয়, খ্রিস্টকে যে তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল, ইস্টার তার ধারাও বহন করে চলেছে ‘প্যাশন’-এর মধ্য দিয়ে। খ্রিস্টের শেষ যাত্রা স্মরণ করে ফিলিপিন্স এবং মেক্সিকোয় মানুষ ভারী ক্রুশকাঠ বহন করে নিয়ে যান এবং নিজেদের বেত্রাঘাত করে চলেন যতক্ষণ না রক্তপাত ঘটে। অনেকে মাথায় কাঁটার মুকুটও পরেন। প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিস্টধর্ম এই ধরনের আচার বন্ধ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সম্পূর্ণ সফল হয়নি। স্বভাবতই মনে পড়ে মহরমের কথা, মনে পড়ে চড়কের সময় বাণ-ফোঁড় কিংবা পিঠে শিক গেঁথে চক্রাকারে ঘোরার প্রথাও। আবার অনেক ক্যাথলিক দেশে বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনা অনুসরণে তৈরি নানান ছবি ও মূর্তি নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়, যার সঙ্গে হিন্দুদের উত্সবের অদ্ভুত মিল আছে।
শীতার্ত ইউরোপে বসন্তসমাগমে মানুষের মনে পড়ে, এ বার স্নান করার সময়। অতএব হাঙ্গারি ও ভূতপূর্ব যুগোস্লাভিয়ার দেশগুলিতে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা মানুষের গায়ে ঠান্ডা জল ঢালা হয়। অতীতে পুরুষরা এই সময় নানান সুগন্ধি বা সুরভিত জল দিয়ে মেয়েদের মনোরঞ্জন করতেন। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ হল চেক এবং স্লোভাক দেশগুলিতে প্রচলিত একটি প্রথা। সেখানে পুরুষরা সত্যি সত্যিই মেয়েদের পেটায়, তবে উইলোর ডাল কিংবা রঙিন ফিতে দিয়ে। সমাজমানসে এই রীতি এতই দৃঢ়মূল যে, ইস্টার হুইপ দিয়ে না মারলে মেয়েরা নাকি ক্ষুণ্ণ হত! আশা করা যায়, এই ঐতিহ্যের দ্রুত অবসান হচ্ছে। তবে মানুষ একটা ক্ষমতা কোনও দিন হারাবে না। যে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তা সে যত ভাবগম্ভীর বা বেদনাময়ই হোক, তাকে উপলক্ষ করে সে নিজের বেঁচে থাকাকে উদ্্যাপন করে চলবে। উচ্ছ্বসিত, উত্ফুল্ল, উষ্ণ উদ্্যাপন।