‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর ঢক্কনিনাদ চারিদিকে চলছে। অগাস্ট মাসে এসব শুনলে সাধারণ লোকের মধ্যে দুটো ধারণা তৈরি হতে বাধ্য। এক, বর্তমান মোদি জমানা পূর্ববর্তী যে কোনও জমানার চেয়ে অধিকতর আগমার্কা জাতীয়তাবাদী। দুই, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি এরা ভীষণ শ্রদ্ধাশীল।
‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর ঢক্কনিনাদ চারিদিকে চলছে। অগাস্ট মাসে এসব শুনলে সাধারণ লোকের মধ্যে দুটো ধারণা তৈরি হতে বাধ্য। এক, বর্তমান মোদি জমানা পূর্ববর্তী যে কোনও জমানার চেয়ে অধিকতর আগমার্কা জাতীয়তাবাদী। দুই, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি এরা ভীষণ শ্রদ্ধাশীল।
মোদি জমানায় জাতীয়তাবাদ নিয়ে আবেগ প্রাবল্য সর্বাধিক সেটা স্পষ্টত অনুভববেদ্য হয়ে ওঠে জাতীয় পতাকা নিয়ে এই জমানায় মাতামাতির বহর লক্ষ্য করলে। জাতীয় পতাকার প্রতি যে কোনও অশ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি বা সংগঠনকে শাস্তিদানের জন্য এরা মুখিয়ে থাকে। এই ধর্মান্ধসুলভ আচরণ আদতে এদের পূর্বসূরি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ এবং হিন্দু মহাসভার ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল মনোভাবের ইতিহাস আড়াল করার প্রয়াস।
হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থীরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তার সদস্যদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আর সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু মহাসভা সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। এই ভূমিকা বিশেষভাবে বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময়— যখন ব্রিটিশরা হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীকে জেলবন্দি করছিল এবং তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাচ্ছিল। এখন গেরুয়া পক্ষের জাতীয় পতাকার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধাশীলতা এবং স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ কেন্দ্রিক জাতীয় উৎসব পালনের আদিখ্যেতা, দুটোই ইতিহাসের একটা কুৎসিত সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা। এই দুটোই আদতে দেশপ্রেম ও তৎসংশ্লিষ্ট গৌরব আত্মসাতের মোদিসুলভ চেষ্টা।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১৯৪৭-এর ১৭ ও ২২ জুলাই সংখ্যার মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ আরএসএস কংগ্রেসের মত ও পথের প্রকাশ্য বিরোধিতার কথা ঘোষণা করেছিল। এই পত্রিকায় বলা হয়েছিল, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কোনও দিন তেরঙা জাতীয় পতাকাকে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করবে না। কারণ, ‘তিন’ সংখ্যাটাই অশুভর ব্যঞ্জনাবাহী আর তাই যে পতাকার তিনটে রং আছে সেটা জনমানসে নিঃসন্দেহে খারাপ প্রভাব ফেলবে এবং দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে।
এই যুক্তিতে হিন্দু ধর্মের ত্রিদেব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর, অগ্রহণীয় এবং ভগবতগীতায় বর্ণিত ত্রিগুণ বর্জনীয়। ত্রিশূলেও তিনের প্রকাশ, তাই এটাও অশুভ! ‘বাঞ্চ অব থট্স’ শীর্ষক গ্রন্থে আরএসএস-এর দ্বিতীয় সংঘচালক বা শীর্ষ ব্যক্তিত্ব এমএস গোলওয়ালকর স্বাধীন ভারতের পতাকার সর্বৈব বিরোধিতা করেছেন। তিনি লিখেছেন, "আমাদের নেতৃবর্গ দেশের নতুন পতাকা নির্ধারণ করেছেন, কিন্তু তাঁরা এমনটা করলেন কেন?... আমাদের দেশ সুপ্রাচীন এবং মহান, সেটির একটি মহান অতীত রয়েছে। তাহলে কি আমাদের নিজস্ব কোনও পতাকা ছিল না? হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের কি কোনও জাতীয় প্রতীক বলে কিছু ছিল না? নিঃসন্দেহে ছিল। তাহলে আমাদের মননে এমন শূন্যতা কেন?"
গোলওয়ালকর আমাদের প্রাচীন পতাকা বা ভারতের জাতীয় প্রতীক বলে যেটা তুলে ধরতে চেয়েছেন সেটা হল ‘ভাগওয়া ধ্বজ’ বা গেরুয়া রঙের চেরা পতাকা। এটা পুরোপুরি হিন্দু পতাকা। তা ছাড়া যে বিষয়টা গোলওয়ালকরের নজর এড়িয়ে গিয়েছে সেটি হল, জাতীয় ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা ভারতীয় সভ্যতার বহুত্ববাদের প্রতিনিধিত্ব করছে।
গোলওয়ালকর আমাদের প্রাচীন পতাকা বা ভারতের জাতীয় প্রতীক বলে যেটা তুলে ধরতে চেয়েছেন সেটা হল ‘ভাগওয়া ধ্বজ’ বা গেরুয়া রঙের চেরা পতাকা। এটা পুরোপুরি হিন্দু পতাকা। তা ছাড়া যে বিষয়টা গোলওয়ালকরের নজর এড়িয়ে গিয়েছে সেটি হল, জাতীয় ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা ভারতীয় সভ্যতার বহুত্ববাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। গান্ধী-হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ১৮ মাসের জন্য যখন ভারতের তদানীন্তন উপ প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আরএসএস-এর নেতৃবর্গকে জেলবন্দি করলেন, তখন আরএসএস জাতীয় পতাকার বিরোধিতার পথ পরিহার করে। জুলাই, ১৯৪৯-এ কারামুক্তির শর্ত হিসেবে তাদের মুচলেকা দিতে হয়েছিল যে তারা ভারতের জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। আর এখন আমাদের দেখতে হচ্ছে, জাতীয় পতাকার প্রতি যথাবিহিত মর্যাদা প্রদর্শনের অভাব ঘটলে নিরীহ নাগরিকদের পেটানোর দায়িত্ব নিচ্ছে সংঘ পরিবারের বাহুবলীরা।
আমারা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৮১ তম বর্ষপূর্তি পালন করছি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীর দল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে কীভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন বয়কট করেছিল। ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্ব অবতার ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি হিন্দু মহাসভা ত্যাগ করে এই সংগঠনটি গড়ে তোলেন। তিনি আবার ভারত ছাড়ো আন্দোলন বয়কটের ক্ষেত্রে বাকিদের তুলনায় একধাপ এগিয়ে ছিলেন।
১৯৩৭-এর নির্বাচনে বৃহত্তম দলের মর্যাদা পেল কংগ্রেস। কিন্তু তারা অবিভক্ত বাংলায় প্রাদেশিক সরকার গঠনের প্রশ্নে এ কে ফজলুল হককে সমর্থনের ব্যাপারে অস্বীকৃত হল। তখন শ্যামাপ্রসাদ হক-মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করেননি। ১৯৩৫-এর ভারতশাসন আইনের অধীনে ব্রিটিশ সরকারের আশীর্বাদ ও মদতপুষ্ট মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। ১৯৪২-এর মাঝামাঝি যখন গান্ধীজি ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’র ডাক দিলেন তখন শ্যামাপ্রসাদ বুঝলেন ব্রিটিশ সরকার এবার প্রমাদ গুনছে।
ঠিক তার আগে ১৯৪২-এর ২৬ জুলাই, বাংলার গভর্নর জন হারবার্টকে তিনি একটি বিতর্কিত পত্র লিখে বসলেন। সেই পত্রে স্বাধীনতার লড়াইকে প্রবলভাবে সমালোচনা করা হল। তিনি আর্জি জানালেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে, ‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যদি কেউ জনগণের আবেগে নাড়া দিয়ে অভ্যন্তরীণ গােলযোগ বাধায় কিংবা নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, তবে সরকারের তাকে অবশ্যই প্রতিহত করা উচিত। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইংরেজ সরকারের আরও প্রীতিভাজন হওয়ার জন্য শ্যামাপ্রসাদ গভর্নরকে লিখলেন, "এই সংকট মুহূর্তে দেশ ও রাজ্যের সেবা করার জন্য আপনার একজন মন্ত্রী হিসেবে আমি আপনার সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।"
তার আগে তাঁর নেতা ভি ডি সাভারকর তো জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে একটা পরম্পরা তৈরি করে দিয়েছেন। সেই পরম্পরা অনুসরণ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গভর্নর হারবার্টকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, "বাংলার প্রাদেশিক সরকার এমনভাবে প্রশাসন চালাবে যে আপ্রাণ চেষ্টা করেও কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হবে।" তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন সরকার বাহাদুরকে যে, তাঁর দলের মন্ত্রীরা জনগণকে বোঝাবেন যে স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেস আন্দোলন শুরু করেছে সেই স্বাধীনতা ইতিমধ্যে জনপ্রতিনিধিরা পেয়ে গিয়েছেন... ভারতীয়দের উচিত ব্রিটিশদের ওপর ভরসা রাখা।
এটাই হল নরেন্দ্র মোদিদের রাজনৈতিক গুরুকুলের পরম্পরা। স্বাধীনতা দিবসের দিন লালকেল্লায় কারা ভাষণ দিচ্ছেন, জাতীয় পতাকাকে কারা অভিবাদন জানাচ্ছেন, সে অধিকার আদৌ তাদের আছে কি না, সেটা আবার আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে।