হাতে ঠিক তিন দিন সময়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হঠাৎ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নির্দেশ পাঠাল, ৩১ অক্টোবর সর্দার বল্লভভাই পটেলের জন্মদিন পালন করতে হবে। ‘একতার জন্য দৌড়’, আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতা, নাটক, গান-বাজনা, প্রবন্ধ লেখার আয়োজন করতে হবে, টি-শার্ট বানাতে হবে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। এই গোত্রের হুকুম দেওয়ার কোনও এক্তিয়ার যে তাদের নেই, সে কথা ভুলে গিয়ে কমিশন আদেশ করল, অনুষ্ঠানের ছবিসহ রিপোর্ট পাঠাতে হবে দিল্লিতে।
এহেন বিচিত্র আদেশের ফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে— দেশ জুড়ে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে ইউজিসি। যে শিক্ষাজীবী, বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ বলে দাগিয়ে দেওয়া যাবে। সে অনিবার্যতা এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। বরং, এই মুহূর্তে যে কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন, কিছু দিন আগে ইউজিসি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হুকুম করেছিল, টেলিভিশন সেট লাগিয়ে নরেন্দ্র মোদীর দীনদয়াল উপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য লাইভ সম্প্রচার করতে হবে। উপাধ্যায় নেহাতই মোদীর দলের অতীত নেতা, পটেলের মতো জাতীয় ব্যক্তিত্ব নন। ইউজিসি-র নির্দেশটি অবাক করেছিল, কারণ তখন প্রকাশ জাভড়ে়কর মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্বে এসে গেছেন, এবং তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্রের গুরুত্ব তাঁর পূর্বসূরি স্মৃতি ইরানির তুলনায় অনেক বেশি বোঝেন। অনুমান করা চলে, তাঁর ওপর বেশ রকম চাপ ছিল।
৩১ তারিখে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বললেন, এর আগে সব সরকারই পটেলকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছে। সেই তালিকায় যে অটলবিহারী বাজপেয়ীর তিনখানা সরকারও আছে, মোদী সম্ভবত খেয়াল করেননি। প্রশ্ন হল, সর্দার পটেলকে শুধু তারাই সম্মান করে, এই কথাটি প্রতিষ্ঠা করতে বিজেপি মরিয়া কেন? ক্ষুব্ধ পতিদার বা পটেল সম্প্রদায়ের মন জিততেই হবে যে। হার্দিক পটেলের আন্দোলনে বিজেপির দীর্ঘ দিনের শক্ত ঘাঁটি পতিদার-পটেল সম্প্রদায়ের ভোট ব্যাংকে চিড় ধরেছে। অক্টোবরের ২২ তারিখ পতিদার অনামত আন্দোলন সমিতির উত্তর গুজরাতের আহ্বায়ক নরেন্দ্র পটেল সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে অভিযোগ করলেন, বিজেপি তাঁকে দলে যোগ দেওয়ার জন্য এক কোটি টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর হাতে এ বিষয়ে প্রমাণ রয়েছে।
এই দাবির সত্যাসত্য জানি না। তবে এটুকু জানি, বিজেপির পূর্বসূরি এবং অভিভাবক হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, আর তাদের বিপরীতে থাকা সমগোত্রীয় মুসলমান রাজনীতির দলগুলির বিরুদ্ধে সবচেয়ে কড়া হাতে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যিনি, তাঁর নাম সর্দার বল্লভভাই পটেল। গাঁধী-হত্যার পর তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পটেল আরএসএস-কে সটান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। দিনকয়েক পরে তিনি নেহরুকে জানান, তিনি কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছেন এবং আরএসএস যে গীতা ক্লাস চালায়, সেখানে কী বলা হচ্ছে, সে দিকেও তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন। প্রায় এক মাসের মাথায় তিনি নেহরুকে খবর দিলেন, ‘আরএসএস-এর কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে দিল্লিতে কয়েক জন সরকারি কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে, পটেলের বিশ্বাস ছিল, ‘সাভারকরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হিন্দু মহাসভার কিছু উগ্র সদস্য এই খুনের ষড়যন্ত্র করে, এবং তাকে বাস্তবায়িত করে।’ তাঁর মত ছিল, ‘আরএসএস-এর অজস্র পাপ রয়েছে বটে, কিন্তু গাঁধীহত্যা তাদের কাজ নয়।’ তবে, তিনি খেয়াল করেছিলেন, গাঁধীর নীতির কট্টর বিরোধী আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা তাঁর হত্যায় আনন্দিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ১৮ জুলাই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে পটেল লেখেন, ‘আরএসএস-এর কার্যকলাপ দেশে সরকারের অস্তিত্বের পক্ষে বিপদের কারণ হয়ে উঠছে... সংগঠনটি দেশ জুড়ে বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করে চলেছে।’
আরএসএস-এর প্রধান মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য পটেলের কাছে বারংবার অনুরোধ করেন। কিন্তু, পটেল দেড় বছর নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন। শেষ অবধি ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে নিষেধাজ্ঞা উঠল, কিন্তু তার জন্য সংগঠনটিকে মুচলেকা দিয়ে জানাতে হল যে তারা সব রকম হিংসার থেকে দূরে থাকবে, এবং গোপন কার্যকলাপ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবে। এবং, সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হল, তারা এত দিন ধরে যে সংবিধান এবং জাতীয় পতাকার বিরোধিতা করে এসেছিল, আরএসএস জানাল, অতঃপর তারা সেই সংবিধান ও পতাকার প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থাকবে। আজ বিজেপি জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীত নিয়ে বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছে, অনুমান করা চলে, তার একটা বড় কারণ হল অতীতকে ধামাচাপা দেওয়া। গুজরাতে পটেল-পতিদার ভোট ফিরে পাওয়ার লোভে যে বল্লভভাই পটেলকে বিজেপি তাদের ‘জাতীয় নায়ক’-এর আসনে বসাতে চায়, তাঁর সম্বন্ধে এই সত্যি কথাগুলি জনসমক্ষে স্বীকার করার ক্ষমতা কি দলের আছে, না কি ইতিহাসের এই কিল হজম করে নেওয়াই তাদের কৌশল হবে?
কংগ্রেসের ঘরেই কেন নেতা খুঁজতে হয় নরেন্দ্র মোদীদের? তার সহজ কারণ, তাঁদের হিন্দু দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে এমন কোনও নেতা নেই, রাজনৈতিক মতনির্বিশেষে যাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরামরাও হেডগাওয়াড় ‘ভারত ছাড়ো’-র মতো আন্দোলনের সময় সচেতন ভাবেই গাঁধী এবং কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। বস্তুত, ঔপনিবেশিক আমলের স্বরাষ্ট্র দফতরের রিপোর্টে পাওয়া যায় যে আরএসএস ব্রিটিশ প্রভুদের প্রতি নিতান্তই অনুগত ছিল, এবং কখনও কোনও সমস্যার কারণ হয়নি। বিজেপি-র অন্য পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে আন্দামানে দ্বীপান্তরে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বহু বার ক্ষমাপ্রার্থনা করে চিঠি লিখেছিলেন। আর সেলুলার জেলে অত্যন্ত দুর্ভোগ সহ্য করা কয়েকশো বিপ্লবীকে ভুলে— যাঁদের সিংহভাগই ছিলেন বাঙালি— এনডিএ সরকার আন্দামানের বিমানবন্দরটির নাম রাখল বীর সাভারকরের নামে!
স্বাধীন ভারতেও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে কোনও সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা তৈরি হলেন না কেন? তার কারণ, তাঁরা মূলত আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতিই করে গিয়েছেন। জরুরি অবস্থা বাদে দেশে কোনও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক মুহূর্তে তাঁদের কোনও উপস্থিতিই ছিল না। তা ছাড়া, তাঁরা খুব বেশি দিন ক্ষমতায় ছিলেন না, এই কথাটাও মনে রাখতে হবে। বিজেপির ঘরে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু, ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার পর তিনি রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্বন্ধে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা-ও মানুষের স্মৃতিতে আছে। আর এক জন বড় মাপের নেতা ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু, গুজরাতের বা উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ের রাজনীতির প্রেক্ষিতে দেখলে, তিনি সুদূরবর্তী একটি রাজ্যের নেতামাত্র। স্বামী বিবেকানন্দের গেরুয়া বস্ত্র দেখে তাঁকে দলে টানার চেষ্টা করা হয় বটে, কিন্তু যাঁরা সেই চেষ্টাটি করেন, তাঁদের ধারণাও নেই যে সাম্প্রদায়িক উগ্রতাকে স্বামীজি কতখানি কড়া ভাষায় নিন্দা করেছিলেন।
কাজেই, বিজেপি তাঁদের প্রতীক হওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব— আইকন— খুঁজেই চলেছে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কথাও ওঠে। বলা হয়, গাঁধী পরিবার তাঁকে সম্পূর্ণ অবহেলা করেছিল। কিন্তু, লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর যোশী, যশবন্ত সিনহা বা অরুণ শৌরির মতো প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীরা এখন ঠিক কী করছেন, সেই প্রশ্নের উত্তর বিজেপি দেয় না। সম্প্রতি দক্ষিণপন্থী সংবাদপত্র স্বরাজ্য কালাজ্বরের উপশমকারী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর খোঁজ পেয়েছে, এবং অবিলম্বে জানিয়েছে, এই ‘সন্ত’কে বাঙালি ভুলে গিয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও এমনই একটা প্রচার চলছে। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের সময় হলে নিশ্চয়ই এমন আরও অনেকের ‘সন্ধান’ বিজেপি পাবে।
কিন্তু আপাতত পটেলের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সরকার যখন এতই বল্লভভাই পটেলের ভক্ত, তবে ১৯৪৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর সর্দার পটেল যে কথাগুলি বলেছিলেন, সেটাকেই স্লোগান করে নিক না কেন— ‘ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং কোনও দিনই তার অন্যথা হবে না।’