মহাবীর জৈন ধর্মে প্রবর্তক। কিন্তু এই বাংলার সঙ্গেও যে রয়েছে তাঁর গভীর সংযোগ, অনেকে তা জানে না। মূলত, বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে তাঁর সংযোগের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, যা প্রাচীনকাল থেকে 'রাঢ়' নামে পরিচিত।  বর্ধমানের আসানসোল-দুর্গাপুর অঞ্চলের (বর্তমানে পশ্চিম বর্ধমান জেলার অন্তত) অতিরিক্ত জেলাশাসক (অ্যাডিশনার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা এ ডি এম) হিসাবে একটা সময়পর্ব কাটিয়েছি। তখন পাঁচরা নামের একটি জায়গা বিখ্যাত এক জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছিল। পাঁচরা, আসানসোল মহকুমার বারাবনি ব্লকের কেলেজোড়া থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত, একটি বড় গ্রাম। 'পাঁচরা' নামের ব্যুৎপত্তি লুকিয়ে রয়েছে ওই মন্দিরেই। 'পাঁচ-চূড়া" কিংবা পাঁচটি টাওয়ার বা শীর্ষ-সহ ওই মন্দির থেকেই কথ্যভাষায় এমন নাম। প্রচুর জৈন প্রত্নবস্তু পাওয়া গিয়েছে এখানে, এবং সেগুলো গ্রামে বিভিন্ন স্থানে রাখা আছে।

সমগ্র বর্ধমান ( পশ্চিম ও পূর্ব) এবং রাঢ় অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী পুরুলিয়া, বীরভূম এবং বাঁকুড়া জেলায়, বেশ কয়েকটি 'ন্যাংটেশ্বর' (নগ্ন) শিব মূর্তির মন্দির রয়েছে, এবং সেখানে পুজোও করা হয়। এগুলো আদপে জৈন তীর্থঙ্করদের বস্ত্রহীন দিগম্বর ভাস্কর্য। যা থেকে জৈন ধর্মের সঙ্গে এই অঞ্চলের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সংযোগের সাক্ষ্য মেলে। একটি তত্ত্ব রয়েছে এই মর্মে যে, 'বর্ধমান' নামটি 'বর্ধমান মহাবীর' থেকেই এসেছে। খুব কাছে না হলেও, অনতিদুরেই রয়েছে ধানবাদের পরশনাথ পাহাড়, যা জৈনদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান।

'আচারং সূত্র' অনুসারে, ভগবান মহাবীর দীক্ষালাভের পরেই রাঢ়প্রদেশে গিয়েছিলেন, এবং তাকে বহুবিধ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তৎকালীন বনাঞ্চলের বন্য উপজাতি এবং পশুদের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি। 'ভগবতী সূত্র'-ও বলছে যে, ভগবান মহাবীর রাঢ়প্রদেশের একটি অংশ, 'পানিত ভূমি'-তে, বহু 'চতুর্মাস' কাটিয়েছিলেন। এখানেই শূলপাণি যক্ষ মহাবীরের উপর অগণিত অত্যাচার হেনেছিলেন। মহাবীরকে ওসহ্য যন্ত্রণা দেওয়ার অভিপ্রায় নিজেকে কখনও বন্য হাতি, কখনও ভয়াল ভূত এবং কখনও বিষাক্ত সাপে রূপান্তরিত করেছিলে। এই স্থানটিই অস্থিগ্রাম নামে পরিচিত ছিল পুরাকালে। বর্তমানে বর্ধমানের 'নূতনহাট' নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি। যক্ষ এখানে 'শূলপান শিব" নামে পূজিত হন।

সংলগ বীরভূমে, মহাবীরকে, একটি বিপজ্জনক বন অতিক্রম করতে হয়েছিল, যেখানে কানাখাল আশ্রম অবস্থিত। জৈন ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে উল্লেখ মেলে, কীভাবে তিনি 'চাঁদকৌশিক' নামের এক মারাত্মক সাপের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এই সাপ বহু মানুষ ও পশুকে হত্যা করেছিল তার বিষে। মহাবীর অবশ্য এই সাপটিকে বশে এনেছিলেন, শান্ত করেছিলেন, সাইথিয়ার কাছে উশকা গ্রামের 'যোগী পাহাড়ি' নামে একটি জায়গায়। ২৫ বছর ধরে গবেষণার পর, শ্রীভোজরাজজি পরখ এই স্থানটি শনাক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালের ২২ জানুয়ারি, কলকাতার পঞ্চবটি জৈন মন্দিরে ভগবান মহাবীরের পদচিহ্ন বহনকারী একটি ছোট উপাসনা স্থল স্থাপন করা হয়েছিল।

'বীর-ভূমি' বা 'বীরভূম' নামটি মহাবীরই দিয়েছিলেন বলে কথিত। প্রাচীন রাঢ়প্রদেশের রাজা এবং সেখানকার প্রধান শহর শ্বেতাম্বিকের লোকেরা মহাবীরকে দুর্দান্ত এক সংবর্ধনা দিয়েছিল, আর সেই দিনেই এই নামকরণ সাধিত হয। সাঁইথিয়ার নিকটবর্তী আমুয়ার স্থানীয়রা এখনও বিশাস করে যে, মহান আধ্যাত্মিক এক যুগপুরুষকে তাদের প্রাচীন শাসক স্বাগত জানিয়েছিলেন। এহেন বিশ্বাসেই তারা দেই গাছটিকে এখনও পুজো করে, যেখানে সেই সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। ঐতিহ্য হিসাবে, ওখানকার প্রতিটি পরিবার গাছটির কাছে প্রতিবছর মাটির নৈবেদ্য দেয়। নদীর ধারে হওয়া সত্ত্বেৎ, মুষলধারে বৃষ্টির পরেও, সেই গাছ এবং তার আশপাশের জমি কখনও প্লাবিত হয়নি।

প্রাচীন বঙ্গে জৈন ধর্ম ও সেই সংক্রান্ত ইতিহাস সম্পর্কে আরও বেশি করে জনমানসে প্রচার প্রয়োজন।

 

No comments on 'রাঢ়প্রদেশে মহাবীরগাথা'

Leave your comment

In reply to Some User