শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আগস্ট বিপ্লবকে ব্যর্থ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তিনি তখন ফজলুল হক মন্ত্রিসভার বরিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। ’৪২-এর জুলাই মাসে তিনি লিখিত ভাবে সাম্রাজ্যবাদ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানান এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার জন্যে সওয়াল করেন।
গান্ধী জয়ন্তী দিন মনে পড়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) আর হিন্দু মহাসভা কি ভাবে ক্রমাগত তাঁর বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। শুধু তাই না, তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে সব সময় দূরত্ব বজায় রেখেছে। এমনকি ১৯৪২-এ গান্ধীজির ডাকা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, যাকে দেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে সঙ্কটময় মুহূর্ত বলা হয়, সেই সময়ও এই দুই সংস্থা ব্রিটিশ সরকারেরই পাশে ছিল, গান্ধীর দিকে নয়। মহাসভার সাভারকর ইংরেজদের সরাসরি সাহায্য না করলেও পরোক্ষ ভাবে মদত জুগিয়েছেন।
কিন্তু তাঁরই দলের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আগস্ট বিপ্লবকে ব্যর্থ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তিনি তখন ফজলুল হক মন্ত্রিসভার বরিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। ’৪২-এর জুলাই মাসে তিনি লিখিত ভাবে সাম্রাজ্যবাদ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানান এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার জন্যে সওয়াল করেন। পরবর্তীকালে তিনি আজকের ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্বসূরি ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পূজিত। বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু যখন শাসকেরা তাঁকে কোনো গুরুত্বই দিলেন না, তিনি তখন অন্য সুরে লিখলেন। কয়েক মাস পরে ওই মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করলেন আর সেই সময় ব্রিটিশ রাজের অনেক গালমন্দ করলেন। যেই হিন্দু মহাসভা গান্ধীকে দেশ বিভাজনের জন্যে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে হত্যা করল, সেই দলের নেতা শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু এই মহাদেশের পূর্ব অঞ্চলে বঙ্গভঙ্গের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন।
আরএসএস গান্ধী বিদ্বেষ আরও ধারালো ছিল আর সাংগঠনিক শক্তি অনেক বেশি ভয়াবহ। এই সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার কিন্তু এক সময় গান্ধীকে অনুসরণ করতেন এবং তার জন্যে শাস্তিও পেয়েছিলেন। তিনি অবশ্য গান্ধীর মুসলমান প্রীতি একেবারেই মানতে নারাজ, তাই সাভারকরের কাছে চলে গেলেন। আগেই বলা হয়েছে যে, তাঁর সঙ্ঘ জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনো ভূমিকা নেয়নি। এবং গান্ধীর পথকে সর্বনাশী ভুল পথ বলে বহু সমালোচনা করেছিল।
এখন অবশ্য আরএসএস দাবি করে যে ১৯৩৪ সালে ওয়ার্ধা আশ্রম থেকে গান্ধী গিয়েছিলেন তাঁদের একটি শাখা দেখতে আর তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীর সঙ্গে সম্পর্ক যে কখনোই মধুর ছিল না, তা নথি ঘাঁটলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যাওয়া যাক সরাসরি ১৯৪৭-এর অগস্ট মাসে। আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ জানাল যে নতুন ভারতের জাতীয় তেরঙা পতাকা কখনওই হিন্দুদের আপন, শ্রদ্ধার হয়ে উঠবে না। ‘তিন’ শব্দটাই অশুভ এবং তিন বর্ণবিশিষ্ট জাতীয় পতাকা নিশ্চিত ভাবেই খুব খারাপ, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। ‘অর্গানাইজার’-এর ১৭ ও ২২ জুলাই সংখ্যাতেও এমন আরও অনেক জাতীয় বিষয়ে আরএসএস-এর বিরোধিতার কথা লেখা। এমনকি, আরএসএস-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘ-চালক, এম এস গোলওয়ালকর তাঁর বই ‘বাঞ্চ অব থটস’-এ আক্ষেপ করেছেন ভারত কেন আরএসএস-এর গৈরিক চেরা পতাকাকে রাষ্ট্রীয় বলে মেনে নিচ্ছে না। আরএসএস আরও চেয়েছিল মনুস্মৃতিকে ভারতের সংবিধান বলে গ্রহণ করা হোক।
সবাই স্বীকার করেছে যে স্বাধীনতা ও দেশ বিভাজন ঘোষণার ঠিক পরই যে কলকাতায় কোনো বিধ্বংসী খুনোখুনি হয়নি, তার জন্যে মহাত্মাকে কৃতিত্ব দিতে হবে।
এই ভাবে স্বাধীনতার পর প্রায় ১৮ মাস ধরে আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা গান্ধী ও তাঁর সমর্থকদের প্রচণ্ড গাল দিয়ে তাদের বিরোধ চালিয়ে গেল। আরএসএস এক দিকে উদ্বাস্তুদের মধ্যে কিছু সেবা করল ঠিকই কিন্তু তাঁদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খুনোখুনি শুরু করল। গান্ধী অবশ্য এই সময় ব্যস্ত ছিলেন পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের ক্ষোভকে একটু শান্ত করতে আর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সামলাতে। সবাই স্বীকার করেছে যে স্বাধীনতা ও দেশ বিভাজন ঘোষণার ঠিক পরই যে কলকাতায় কোনো বিধ্বংসী খুনোখুনি হয়নি, তার জন্যে মহাত্মাকে কৃতিত্ব দিতে হবে।
কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার এই আত্মশক্তির অদ্ভুত নিদর্শনকে লিখিত ভাবে ব্যঙ্গ করেছিল আর গান্ধীকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণও। তা সত্ত্বেও যখন আরএসএসের প্রধান গুরু গোলওয়ালকর দেখা করতে চাইলেন, তিনি রাজি হলেন আর ১৯৪৭-এর ৯ সেপ্টেম্বর তাঁরা সামনে বসে আলোচনা করলেন। গান্ধী যখন সোজাসুজি তাঁকে বললেন যে সঙ্ঘের হাত রক্তে মাখা, গোলওয়ালকর উচ্চ সুরে তা অস্বীকার করলেন। ১৬ সেটেম্বর তারিখে তিনি দিল্লির ভাঙি কলোনিতে অবস্থিত আরএসএসের একটি শাখায় গিয়ে তাঁর শান্তির বাণী প্রচার করেন, যা বর্তমান সরকার তাঁর মানপত্র হিসেবে বিবেচনা করে। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এই সময়কার পুলিশ দপ্তরের অগণ্য লেখা উত্থিত করে অবশ্য বলেছেন যে সঙ্ঘ পরিবার দাঙ্গায় শুধু নেতৃত্ব দেয়নি, তাঁরা লাগাতার গান্ধী ও স্বাধীন সরকারের জুগুপ্সা চালিয়ে গেছে।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই পটেল আরএসএস ও মহাসভাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। তাঁদের নেতাদেরও কারারুদ্ধ করলেন দেড় বছর। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মৃদু আবেদন বা গোলওয়ালকরের প্রচুর ক্ষমাপ্রার্থনা তিনি মানলেন না। নেহরুকে লেখা তাঁর চিঠিগুলি থেকে দেখা যায় যে হিন্দু মহাসভার এক উগ্র সমর্থক এই হত্যা করেছে। কিন্তু এই ঘৃণ্য কাজ করতে সুবিধে করেছে আরএসএসের আর মহাসভার বিষাক্ত প্রচার আর দেশ বিভাজনের দায়িত্ব গান্ধীর ওপর ন্যস্ত করার অপপ্রচার।
তিনি নেহরুর সর্বদলীয় সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদবাবুকে বেশ কয়েক বার সাবধান করেছেন এবং রাগের সঙ্গে জানিয়েছেন যে সঙ্ঘ পরিবার মহাত্মার খুনের পর মিষ্টি বিতরণ করেছিল। পটেল জুলাই, ১৯৪৯ অবধি এই দুই সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলেন না আর কাউকে জেল থেকেও ছাড়লেন না। সর্দার পটেল অনড় রইলেন যতক্ষণ না সঙ্ঘ পরিবার মুচলেকা দিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করল।