উত্তর ভারতে মানুষের বিশ্বাস, গঙ্গা, যমুনা আর রহস্যময়ী সরস্বতীর সংগমে ডুব দিতে পারলে তো পুণ্য তিনগুণ হয়ে যায়। কাশ্মীরি পণ্ডিতরা আবার বসন্তপঞ্চমীর দিনে তান্ত্রিক দেবী টিকি সোরাম-এর উপাসনা করেন।
যুগে যুগে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা মা সরস্বতীকে মনেপ্রাণে ডেকেছে, পরীক্ষাটা যেন ভাল হয়। সরস্বতীকে আমরা ঘরের মানুষ হিসেবে দেখি। তিনি কিন্তু যে সে দেবী নন। বৈদিক যুগের যে গুটিকয়েক দেবদেবীর পুজো এখনও হয়,সরস্বতী তাঁদের এক জন। আজ বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য জায়গায় তিনি বিশেষ পূজিত নন, অথচ সুদূর জাপান আর বালি দ্বীপে তিনি এমন আরাধিত!
মাঘ মাসের পঞ্চমীর দিনটি সারা ভারতে বসন্তপঞ্চমী হিসেবে উদ্যাপিত হয়। বসন্তের দুটি উৎসবের মধ্যে এটি প্রথম, অন্যটা দোল বা হোলি, বসন্তপঞ্চমীর ঠিক চল্লিশ দিন পর। ক্যাথলিকরা আবার এই সময়েই ‘ক্যান্ডলমাস’ বলে একটা উৎসব করেন, আর চিনের মানুষ খুব জাঁকজমক করে পালন করেন তাঁদের নববর্ষ।
চার দিক হলুদ করে সর্ষে ফুলে ফুলে খেত ভরে ওঠে এই সময়। এই উজ্জ্বল রঙই যেন শীতের ছোঁয়াটুকু দূরে সরিয়ে বসন্তের আগমনি নিয়ে আসে। নানা জায়গায় লোকজন ঢোলক বাজিয়ে নাচগানে মেতে ওঠেন। বিহারের মানুষ তো হোলি আসছে এই আনন্দে রং খেলাও শুরু করে দেন। উত্তর ভারতে অনেক জায়গায় হলুদ পাগড়ি আর পোশাক পরার রীতি আছে। অনেকে কপালে হলুদ তিলকও আঁকেন। ব্রজভূমির কথা তো আলাদা করে বলতেই হবে, এই ঋতু রাধাকৃষ্ণের প্রিয় ঋতু। সেখানে বসন্তপঞ্চমীতেই নানা রকম রংবেরঙের উৎসবের মধ্যে দিয়ে হোলির দিন গোনা শুরু হয়ে যায়। সমস্ত মন্দির সাজানো হয় হলুদ ফুল দিয়ে। চাল, দুধ, বরফিতেও হলুদ রঙের ছড়াছড়ি।
পঞ্জাবে গঙ্গা নেই, কিন্তু হিন্দু এবং শিখরা বসন্তপঞ্চমীতে মা গঙ্গার পুজো করেন। উত্তর ভারতে মানুষের বিশ্বাস, গঙ্গা, যমুনা আর রহস্যময়ী সরস্বতীর সংগমে ডুব দিতে পারলে তো পুণ্য তিনগুণ হয়ে যায়। কাশ্মীরি পণ্ডিতরা আবার বসন্তপঞ্চমীর দিনে তান্ত্রিক দেবী টিকি সোরাম-এর উপাসনা করেন। ১৯১৭ সালে মেজর সি এইচ বাক-এর লেখা থেকে জানা যায়, উত্তর ভারতে এই সময় কোথাও কোথাও জগদ্ধাত্রী পুজোও হত। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং সংলগ্ন এলাকায় আমের মঞ্জরী আর গমের শিস দিয়ে শিবের পুজো হয়। এমনকী কামদেব, যিনি কিনা শিবের তপস্যাভঙ্গ করার অপরাধে শিবের রোষে ভস্মীভূত হয়েছিলেন, এই চল্লিশ দিনের মধ্যে তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী রতির পুজো হয়। অনেকেই জানেন না যে, সুফিদের মধ্যে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি আছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে চিশ্তি ধারার সুফি সন্ত নিজামুদ্দিন আউলিয়া বিষাদগ্রস্ত হলে তাঁর মন ভাল করতে কবি আমির খুসরু এই দিন হলুদ রঙের পোশাক পরেছিলেন, সেই থেকেই এই উত্সবের শুরু।
দেবতা হিসেবে বিষ্ণুর প্রতিপত্তি যখন বাড়ল, তখন পুরাণ এই দিনটিতে বিষ্ণুকে খুব গুরুত্ব দিল। ১৯১০ সালে মার্ডক লিখেছেন, পঞ্চমী তিথির আগে ‘শ্রী’ যুক্ত করার অর্থ হল, সরস্বতীর সঙ্গে লক্ষ্মীরও পুজো করতে হবে, এবং আদিতে এই দিনটিতে আসলে লক্ষ্মীরই পুজো হত। তবে একই লেখায় তিনি সরস্বতীকেও খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন, এবং ‘শ্রী’ সরস্বতীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
একশো বছর আগে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজো চালু করেন। উত্তরাখণ্ড অসম ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া খুব কম জায়গায় কিন্তু এ দিন সরস্বতী পুজোর চল আছে। দক্ষিণ ভারতে আশ্বিন মাসে নবরাত্রির শেষ দিনে দেবী সরস্বতীর আরাধনা হয়। বাংলায় সরস্বতী পুজোর এত সমারোহ কেন? একটা কারণ বোধ হয় এই যে, মধ্যবিত্ত বাঙালি বরাবরই একটা ভাল চাকরির স্বপ্ন দেখেছে। সে জন্য পড়াশোনা করতে হত, পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেলেই কোম্পানি কিংবা রানির চাকরি মিলত। আর সেই থেকেই বিদ্যার দেবীকে তুষ্ট রাখার এত প্রচেষ্টা।
নদী হিসেবেও সরস্বতী খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবিশেষজ্ঞ এইচ ডি গ্রিসওয়ল্ড ১৮৯৭ সালে রিলিজন অব দ্য ঋগ্বেদ গ্রন্থে লিখেছেন, সরস্বতী নদীর সন্নিহিত এলাকায় পাঁচটি আর্যগোষ্ঠীর লোকরা সবচেয়ে বেশি সময় থেকেছিলেন, ঋগ্বেদের আদি মন্ত্রগুলি এখানেই জন্ম নিয়েছিল। মিশরের নীলনদ বা মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের মতো আদি বৈদিক সভ্যতার ভরকেন্দ্র হল সরস্বতী।
নদী হিসেবেও সরস্বতী খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবিশেষজ্ঞ এইচ ডি গ্রিসওয়ল্ড ১৮৯৭ সালে রিলিজন অব দ্য ঋগ্বেদ গ্রন্থে লিখেছেন, সরস্বতী নদীর সন্নিহিত এলাকায় পাঁচটি আর্যগোষ্ঠীর লোকরা সবচেয়ে বেশি সময় থেকেছিলেন, ঋগ্বেদের আদি মন্ত্রগুলি এখানেই জন্ম নিয়েছিল। মিশরের নীলনদ বা মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের মতো আদি বৈদিক সভ্যতার ভরকেন্দ্র হল সরস্বতী। আর্যরা যখন এই নদী পার হলেন, তখনই আর্য ও অনার্যের মিলন ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ভারতীয় সভ্যতার সূচনা হল। সরস্বতী নদী হারিয়ে গেছে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ আজও বিশ্বাস করেন যে অন্তঃসলিলা সরস্বতী গঙ্গায় মিশেছে।
পঞ্চম শতাব্দী থেকে ভারতের বেদ-পুরাণের দেবদেবীরা ছিলেন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটা বড় রফতানির বস্তু। বৌদ্ধধর্মের মতোই তাঁদের প্রভাব ছিল বিপুল। বস্তুত, এই বৈদিক ও পৌরাণিক দেবদেবীদের উপরেও কালক্রমে মহাযান বৌদ্ধধর্মের বড় ছায়া পড়েছিল, যেমন আমাদের শান্তিময়ী সরস্বতী তিব্বতে বজ্র নামক দেবীতে পরিণত হন, তাঁর হাতে মারণ-বজ্র! মায়ানমারে প্রাচীন রাজধানী পাগান-এর কাছে লক্ষ্মণসেনের সমকালীন ‘মন’ প্রত্নলিপিতে তাঁর উল্লেখ পাই, এবং দেখি সেখানে তিনি বৌদ্ধ পুথির রক্ষাকর্ত্রী দেবী থুরাথাড়ি রূপে পূজিত। কাম্বোডিয়ায় সপ্তম শতাব্দীতে ব্রহ্মা এবং সরস্বতীর উল্লেখ মেলে, খেমের কবিরা তাঁকে বাগীশ্বরী রূপে বর্ণনা করেছেন। তাইল্যান্ডে তিনি বাক্ এবং বিদ্যার দেবী (প্রো)সুরতস্বরী, অনেক মন্দিরে তাঁর মূর্তি আছে। জাপানে ষষ্ঠ শতাব্দীতে অন্য নানা দেবদেবীর সঙ্গে সরস্বতীও পৌঁছেছিলেন, অষ্টম শতাব্দী অবধি তাঁর আরাধনা হয়েছে। সে দেশে তাঁর নাম বেনজাইতেন, কথাটি এসেছে চিনা বিয়ান-চাইতেন থেকে। কামাকুরা, নাগোরা, টোকিয়োর কিছু মন্দিরে এখনও তাঁর মূর্তি আছে, তাঁর হাতে জাপানের প্রাচীন তারযন্ত্র ‘বিবা’। সে দেশে তিনি সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী সপ্তদেবীর অন্যতমা। মূলত তিনি জলের দেবী, যা কিছু জলের মতো প্রবাহিত, যেমন শব্দ, বাক্য বা গান, তারও। তাঁর সঙ্গে আবার সাপেরও একটা যোগ আছে, সচরাচর তাঁর সঙ্গে সর্প-ড্রাগনের বিয়ে হয়। তবে ভারতের বাইরে প্রধান এক জন দেবতা হিসেবে সরস্বতীর আরাধনা যেখানে প্রচলিত, তার নাম বালি। বালির মানুষ তাঁকে জলের অধিষ্ঠাত্রী মনে করেন, এই দিনটিতে তাঁরা নদী বা সমুদ্র বা পবিত্র ঝরনায় স্নান করেন। আবার স্কুলকলেজে তাঁর বিরাট বিরাট প্রতিমা গড়ে পুজোও হয়। দেবদেবীরা সত্যিই আমাদের বড় রফতানি ছিলেন। কিন্তু আমরা সময়মত পেটেন্ট নিইনি।
সরস্বতী-বন্দনার এই বৈচিত্র সত্যিই অবাক করে দেয়। এবং বুঝতে পারি, ব্রাহ্মণ্যধর্মের শক্তি তার অভিন্নতায় নয়, বরং এত ভিন্ন মত ও বিশ্বাসের টানাপড়েনকে যে ভাবে সামাল দিয়েছে, সেখানেই তার আসল জোর।