সুপ্রিম কোর্টের চার বর্ষীয়ান বিচারকের সাম্প্রতিক সাংবাদিক সম্মেলন কয়েকটা বিষয় একটু অস্বস্তিকর ভাবেই মুক্তকচ্ছ করে দিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের কতকগুলো সুনির্দিষ্ট অবস্থানকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রশ্নের মুখে। যেমন, ২০১৬–র ৩০ নভেম্বর বিচারপতি দীপক মিশ্রের বেঞ্চের অন্তর্বর্তী রায়— ভারতের সমস্ত সিনেমা-হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আগে জাতীয় সংগীত বাজাতে হবে— বিশেষ একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি। মহামান্য বিচারপতি তাঁর রায়ে বলেছিলেন, ‘সব সিনেমা-হলে ছবি শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে হবে।’
বিচারপতি মিশ্র এখন এ দেশের প্রধান বিচারপতি। তাঁর রায়ে বিশেষ একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে, ‘প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত সকলের উঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত’, কারণ ‘মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা’ প্রকাশের এ এক সুযোগ। এগারো মাস পর, সুপ্রিম কোর্টেরই বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের রায়ে পাওয়া গেল আর একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যখন তিনি বললেন, দেশপ্রেমের খুল্লমখুল্লা প্রকাশ যে নাগরিককে করতেই হবে এমনটা নয়। ২৩ অক্টোবর ২০১৭-য় বিচারপতি চন্দ্রচূড় মন্তব্যও করলেন, ‘এর পরে যেটা হবে তা হল, কাউকে বলা হবে, টি-শার্ট বা শর্টস পরে সিনেমা দেখতে আসা যাবে না, তাতে জাতীয় সংগীতের প্রতি অসম্মান দেখানো হবে... এই নীতিপুলিশির শেষ কোথায়?’
ঘটনাচক্রে বিচারপতি চন্দ্রচূড় এর আগে, ৩০ নভেম্বর বিচারপতি মিশ্রের বেঞ্চ-এও ছিলেন। এক বছরের মধ্যে প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের মতান্তর তাই ভারতের বিচারব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি ও ‘ন্যায়বিচার’-এর ক্রমশ পালটে যাওয়া ধারণার বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা উদাহরণ। অন্তর্বর্তী নির্দেশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট তাই পরিষ্কার জানিয়েছে, এ বার সরকার ভাবুক। আর সেই ভাবনায় যেন গত ২০১৬-র রায়ের কোনও প্রভাব না থাকে।
অতি-জাতীয়তাবাদীর ছদ্মবেশে সমাজবিরোধী দুষ্কৃতীরা অবিলম্বেই এই জাতীয় সংগীত বাজানোর ঘোষণাকে ব্যবহার করল, যাঁরা ‘যথেষ্ট দেশপ্রেমী’ নন বলে তাদের সন্দেহ, তাঁদের একটু শিক্ষে দিতে। সত্যি বলতে কী, সিনেমা-হলের পরদায় একটা ডিজিটাল, সিনথেটিক জাতীয় পতাকার অনান্দনিক পতপতানির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাটা কি দেশপ্রেমের ভোল্টেজ খুব একটা বাড়িয়েছে? সিনেমা-হলগুলো জাতীয় সংগীত বাজানোর নির্দেশ প্রথম পেয়েছিল ১৯৬৩ সালে। তখন সরকার যে মনোভাব দেখিয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনা করলে এখনকার পরিস্থিতিটা বড্ড চোখে লাগবে। তখন সময়টা ছিল চিনের অতর্কিত ভারত-আক্রমণের অব্যবহিত পরে, তখন শক্তিশালী এক জাতীয়তাবাদী চেতনা সারা ভারত জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বয়ে যাচ্ছে। সেখানে আলাদা করে দেশপ্রেমের ইঞ্জেকশন পুশ করার কোনও প্রয়োজন পড়েনি।
সেই সময়কার ফাইলপত্তর আর্কাইভ থেকে বের করে দেখা যাচ্ছে, একটা হতমান জাতিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিল-এর গড়া ‘পাবলিক রিলেশনস কমিটি’ সুপারিশ করছে চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে জাতীয় সংগীতের একটি স্ট্যান্ডার্ড রেকর্ডেড ভার্সন বাজানোর, সম্ভব হলে জাতীয় পতাকা সহ। ২৯ জুন ১৯৬৩ তারিখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এই ঘোষণাটি ছিল সুপারিশ, নির্দেশ নয়। ভাষাটা ছিল এ রকম, ‘রাজ্য সরকারগুলিকে অনুরোধ করা হচ্ছে যাতে তাঁরা সিনেমা-হলকে বোঝান’, অর্থাৎ আশা করা হচ্ছে যে এতেই কাজ হবে। তা ছাড়া, বলা হয়েছিল, জাতীয় সংগীত বাজানো হবে শুধু ম্যাটিনি আর ইভনিং, এই দুই শোয়ের পর, যখন বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত দর্শকরা এমনিতেই উঠে দাঁড়িয়েছেন। লক্ষণীয়, এখানে বাধ্যবাধকতা বা নজরদারির কোনও ব্যাপারই নেই।
জাতীয় পতাকা উড়ছে, এমন দৃশ্য-সম্বলিত কোনও স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র সেই মুহূর্তে হাতের কাছে না-থাকায়, ফিল্মস ডিভিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল দু’টো ভার্সন তৈরি করার। ‘বড় বড় শহরের প্রধান সিনেমা-হলগুলোর’ জন্য একটি রঙিন ছবি, আর অন্য সব হল-এর জন্য সাদা-কালো একটা ছবি। ঠিক হল, অবশিষ্ট ভারতবর্ষের সিনেমাহলগুলি কেবল ‘অথরাইজড’ গ্রামোফোন রেকর্ড বাজাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক, অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো ও কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানির (১৯৬৩ সালের ওই আট মাসের) বিপুল ফাইলবন্দি নোট এবং সংশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিকদের পারস্পরিক চিঠিপত্র থেকেই পরিষ্কার, আমলারা সঠিক, বিশদ ও বিতর্কহীন থাকার জন্য কী রকম সচেষ্ট ছিলেন। এই ফাইলগুলোতে ধরা আছে ইতিহাসের টুকরোটাকরাও। যেমন, সুদূর দিল্লিতে বসেও বাবুরা জানতেন, কলকাতার কোন ২৬টা সিনেমা-হলকে ‘প্রধান’-এর মর্যাদা দেওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে ছিল মেট্রো, এলিট, গ্লোব, নিউ এম্পায়ার, লাইটহাউস, মিনার্ভা, হিন্দ, প্যারাডাইস, প্রিয়া, বসুশ্রী, বিজলী, ভারতী, ইন্দিরা, পূর্ণ, শ্রী, আরও কয়েকটা। পরের ধাপে ছিল আরও ৭১টা সিনেমাহল: আলেয়া, অজন্তা, চিত্রা, রিজেন্ট, প্রাচী, উত্তরা, টাইগার, ইত্যাদি। দুই ক্যাটেগরির বেশির ভাগ সিনেমা-হলই আজকের কলকাতায় শুধুই স্মৃতি, হাতে-গোনা কয়েকটা মাত্র টিকে আছে। কে জানে, মানুষ হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ‘উজ্জ্বলা চানাচুর’ বা ‘বিজলী গ্রিল’-এর ইতিহাসও ভুলে যাবে!
১৯৬৩ সালে ফিল্মস ডিভিশন চটপট দু’টো ছবি বানিয়ে ফেলে, সিনেমাহলগুলিকে তা বিক্রিও করা হয়। রঙিন ছবিটির বিক্রয়মূল্য ছিল ৫০ টাকা, সাদা-কালো ছবিটির ৩২ টাকা। বড় শহরগুলির বাইরে থাকা সিনেমা-হলগুলির কাছে যে গ্রামোফোন রেকর্ডটি পৌঁছনো হল, তাতে ছিল ৫২ সেকেন্ড করে তিনটি সাউন্ডট্র্যাক— ষাট জন গায়কের সম্মিলিত ভাবে গাওয়া জাতীয় সংগীত। রেকর্ডের উলটো পিঠেও ছিল জাতীয় সংগীত, তবে এটি সামরিক ব্যান্ডের বাজানো। সিনেমা-হলগুলো যদি ভুল করে রেকর্ডের ওই উলটো পিঠটা চালিয়ে দেয় তা হলে কী হবে, সেই ভাবনায় অনেক আমলার রাতের ঘুম ছুটেছিল— জানা যায় তখনকার দিনের কাগজপত্র থেকে।
যুদ্ধের সময় দেশভক্তি চরমে ওঠে, এ তো জানা কথাই। কিন্তু জাতীয় জীবনে দুর্যোগ কেটে বা থিতিয়ে গেলে যে দেশপ্রেমের জোয়ারেও ভাটা পড়ে, তার মানে এই নয় যে দেশের জনসাধারণ কম দেশপ্রেমিক হয়ে পড়েন। সিনেমা-হলগুলোয় জাতীয় সংগীত বাজানোর ব্যাপারটিও এই গতেরই অনুসারী। আর ১৯৭১ সালের পর থেকে যেহেতু ভারতে মোটের উপর যুদ্ধ হয়নি, এই প্রথাটি তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এখন চারদিক দেখে মনে হচ্ছে যে দেশপ্রেমের অকালবোধন হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যেতে পারে। এটা নথিবদ্ধ সত্য যে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস— যারা জনসঙ্ঘ ও তার উত্তরসূরি ভারতীয় জনতা পার্টির জন্ম দিয়েছে— ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইচ্ছাকৃতভাবেই অংশ গ্রহণ করেনি। আজকের এই ফুলেফেঁপে-ওঠা দেশপ্রেম অতীতের প্রায়শ্চিত্ত, বা বর্তমানের প্রলেপ দিয়ে সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিটুকু মুছে ফেলার চেষ্টা কি না, আমরা সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে পারি না। বস্তুত, ১৯৪৭-এর অগস্টে আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ ঘোষণা করেছিল, ভারতের তেরঙা জাতীয় পতাকা ‘কখনওই হিন্দুদের আপন, শ্রদ্ধার হয়ে উঠবে না। ‘তিন’ শব্দটাই অশুভ, এবং তিন বর্ণবিশিষ্ট জাতীয় পতাকা নিশ্চিত ভাবেই খুব খারাপ এক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলবে, দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে।’
যুক্তিতেই গলদ। হিন্দুদের বহু প্রতীকেই ‘তিন’ সংখ্যাটার অস্তিত্ব— এমনকী ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ত্রয়ী হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস ও পূজার্চনার অচ্ছেদ্য অঙ্গ। ‘অর্গানাইজার’-এর ১৭ ও ২২ জুলাই সংখ্যাতেও এমন আরও অনেক জাতীয় বিষয়ে আরএসএস-এর বিরোধিতার কথা লেখা। এমনকী, আরএসএস-এর দ্বিতীয় সরসঙ্ঘ-চালক, এম এস গোলওয়ালকর তাঁর বই ‘বাঞ্চ অব থটস’-এ আক্ষেপ করেছেন, ‘আমাদের নেতারা দেশের জন্য একটি নতুন পতাকা স্থির করেছেন। কেন করতে গেলেন?... জাতি হিসেবে আমরা প্রাচীন, মহৎ এক জাতি, গৌরবময় অতীত আমাদের। তখন কি আমাদের নিজেদের কোনও পতাকা ছিল না? এই হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের কি কোনও জাতীয় প্রতীক ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। তা হলে এই শূন্যতা, এই চরম মানসিক শূন্যতার অর্থ কী?’ প্রাচীন কোন পতাকা বা জাতীয় প্রতীক ভারত হারিয়েছে, গোলওয়ালকর অবশ্য সে কথা আর বলেননি। আরএসএস-এর সব সময়েই ‘ভগওয়া ধ্বজ’ বা গৈরিক পতাকাটিই বেশি পছন্দের, জাতীয় পতাকার চেয়েও— কারণ সেই পতাকাটি হিন্দুত্বের প্রতিভূ।
ঠিক কোন সময়ে আরএসএস জাতীয় পতাকার বিরোধিতা করা ছাড়ল? কেনই বা ছাড়ল? ইতিহাস বলছে, সর্দার পটেল— ‘বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি’-র আখ্যা লাভের জন্য শাসক দল যাঁর বিশাল মূর্তি বসানোর পরিকল্পনা করছে— ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গাঁধীর হত্যার অব্যবহিত পরেই আরএসএস-কে তুলোধোনা করেছিলেন, নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তার পরের দেড় বছর গোলওয়ালকরের অজস্র অনুরোধেও কর্ণপাত করেননি। রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে, গোপন কার্যকলাপে যুক্ত হবে না এবং হিংসা ত্যাগ করবে, আরএসএস এই শপথ নেওয়ার পর ১৯৪৯ সালের ১১ জুলাই পটেল সেই নিষেধ তুলে নেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ, আরএসএস-কে তখন ‘ভারতের সংবিধান ও জাতীয় পতাকার প্রতি বিশ্বস্ততা’-র কথা স্বীকার করতে হয়েছিল। সেই আরএসএস আর তার রাজনৈতিক সন্তান বিজেপি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার এত বছর পর শেখাচ্ছে দেশপ্রেম কী, কী ভাবে দেশপ্রেমের প্রকাশ দেখাতে হবে— ভাবলেও আশ্চর্য লাগে!