জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা, ইউনেস্কো, কলকাতার দুর্গা পুজোকে এক বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছে। এর নাম ‘ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’, যার মানে সম্পূর্ণ মানব জাতির এক বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা, ইউনেস্কো, কলকাতার দুর্গা পুজোকে এক বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছে। এর নাম ‘ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’, যার মানে সম্পূর্ণ মানব জাতির এক বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এতে শুধুমাত্র গর্বিত হলে হবে না, আমাদের দায়িত্বও অনেকাংশে বেড়ে গেছে।

মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে যে রেড রোড কার্নিভাল শুরু হয়েছে তা সত্যিই অনন্য এবং প্রশংসনীয়। এর ফল পাওয়া যাবেই যাবে আর যত বেশি বিদেশী পর্যটন সংস্থার সাথে চুক্তি করা যাবে ততই এর খ্যাতি আর চাহিদা বাড়বে। এবার ইউনেস্কো সম্মান পাওয়ার পর তো বিদেশি ও দেশি পর্যটকদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা স্বভাবতই বাড়তে থাকবে।

১২ বছর আগে ছৌ নাচ এর ক্ষেত্রে এই একই বিশ্ব সম্মান পাওয়া সত্ত্বেও আমরা তেমন কিছু সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়ে যে এই নৃত্য নিয়ে খুব একটা আগ্রহ জাগানো গেছে বা দর্শকদের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে-এ দাবি করা মুশকিল। ছৌ কেন্দ্রিক পর্যটনের উন্নতির জন্যে তেমন কিছু করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

আসলে এই সব ব্যাপারে, নাগরিকদের সংগঠন অথবা সরকার কোনো বিশেষ কর্মসূচী না নিলে এই ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মানের সম্পূর্ণ লাভ পাওয়া যায় না। অন্য দিকে আমরা দেখি পৃথিবীতে এমন প্রচুর আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা রীতি-পদ্ধতি আছে যেগুলি বিপুল সংখ্যায় পর্যটকদের টানার ক্ষমতা অর্জন করেছে আর লক্ষ লক্ষ ডলার রোজগার করছে। চীনের পিকিং অপেরা বা ড্রাগন নৌকা ফেস্টিভ্যাল এমনকি ওদের চিয়াং নববর্ষ উৎসবের মতন অনেক অনুষ্ঠান প্রচণ্ড ভাবে দর্শক টানে। গ্রীস এক শ্রেণীর পর্যটকদের আকর্ষিত করে তাদের মোমোয়েরিয়া নববর্ষ অনুষ্ঠান দিয়ে আর চেক রাজ্য তাদের Ride of the Kings অর্থাৎ রাজাদের অশ্বারোহণ উৎসবের মাধ্যমে পর্যটক টানে।। অবশ্য সব ইউনেস্কো সন্মানিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা ঐতিহাসিক প্রথাই যে পর্যটক টানতে পারে তা কিন্ত ঠিক নয়।

বছর তিনেক আগে ব্রিটিশ কাউন্সিল আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি যৌথ নিরীক্ষা করে বার করে যে এ রাজ্যের দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে যে সৃজনশীলতা ও সাংস্কৃতিক সম্পদ প্রতিফলিত হয়, যাকে সংস্কৃতির জগতে Creative Industry বলে, তার অর্থনৈতিক অবদান প্রায় ৩২,৩৭৭ কোটি টাকা।

কিন্তু মনে হয় ইউনেস্কোর স্বীকৃত ঐতিহ্য- আমাদের শারদীয়া উৎসবকে দেশের আর দশের কাজে লাগানো যাবে। বছর তিনেক আগে ব্রিটিশ কাউন্সিল আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি যৌথ নিরীক্ষা করে বার করে যে এ রাজ্যের দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে যে সৃজনশীলতা ও সাংস্কৃতিক সম্পদ প্রতিফলিত হয়, যাকে সংস্কৃতির জগতে Creative Industry বলে, তার অর্থনৈতিক অবদান প্রায় ৩২,৩৭৭ কোটি টাকা। এটি আমাদের রাজ্যের বাৎসরিক মূল উৎপাদনের বা জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। সে বছর দুর্গা পূজার পাঁচ দিন ২ লক্ষের বেশি বিদেশী পর্যটক কলকাতায় এসেছিল। আর এই সংখ্যাটির উপর নজর রেখে ওদের সুবিধের জন্য সুব্যবস্থা করতে পারলে দ্বিগুন লাভ করা যায় যার থেকে অগণিত লোকের রুজিরোজগার বাড়তে পারে। বাঙলায় যখন ছোট ও মাঝারি হোটেল এমনিতেই এত বেড়েছে আর হোম-স্টে (সাধারণ পরিবারের সাথে থাকার) ব্যবস্থা সকলে গ্রহণ করে নিয়েছে, স্বল্প মেয়াদি পর্যটকদের সংখ্যা বাড়াতে খুব একটা অসুবিধে হবে না।

বিশ্ব বিখ্যাত যে কোনো স্থান বা উৎসবে কয়েক হাজার পুরুষ ও মহিলা পথনির্দেশক বা শিক্ষিত গাইডের কাজের সুযোগ পায়। দুর্গা পূজাকে ঠিক করে মার্কেটিং করলে আর কারা কি ভাবে সেবা বা পরিকাঠামো দিতে পারবে তার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে তুললে এই রকম পার্ট টাইম কাজ তৈরী হওয়া অনিবার্য। আমি নিজেও তো বিনা পারিশ্রমিকে শুধু আনন্দের জন্যে কত বার গাইডের কাজ করেছি, কলকাতার ইতিহাস ও স্থাপত্য বুঝিয়েছি বিদেশিদের। বিদেশে আমাকে যারা সারা দিন তাদের গাড়িতে ঘুরিয়ে গাইড করেছে অথবা পায়ে হাঁটা পথ ধরে নিয়ে গেছেন তাঁরা কেউই পেশাগত গাইড ছিলেন না। কয়েকজন ডাক্তারির বা আইনশিক্ষার ছাত্র কেউ বা কোম্পানি বা সরকারী কাজ করেন — আর শনি রবি গাইডের কাজ করেন। প্যান্ডেল ও পুজো বিশেষজ্ঞ তৈরী করার জন্য বেশি দিনের প্রয়োজন হবেনা। বিভিন্ন ধরনের বিদেশী ভাষা কত জন বলতে পারেন তার একটি তালিকা তৈরী করা শুরু করা যেতে পারে। কোথায় কি খাবার পাওয়া যায় তারও এলাকা ভিত্তিক লিস্ট-ও পুজো ওয়েবসাইট এ পাওয়াই যায়।।

কিন্তু পুজো শেষ হওয়ার পর পুজো টুরিজম চালানোই হলো আসল চ্যালেঞ্জ। এর মোকাবিলা করা যায় এক বা একাধিক দুর্গা পূজা মিউজিয়াম স্থাপনা করে। সর্বশ্রেষ্ট মূর্তিগুলিকে বেছে এই মিউজিয়ামে সাজিয়ে রাখলে সারা বছর ধরে পর্যটক তো দেখবেই- আমাদের শহর ও রাজ্যের লোকেরাও ভিড় করবে। আগমনী সংগীত, ঢাকের বাদ্য, শাঁখের ধ্বনি, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অতুলনীয় চন্ডীপাঠের স্তোত্র ও আবাহন — সব মিলিয়ে জমজমাট হয়ে উঠবে। এ ছাড়া আমাদের সম্পদ অজস্র ভিডিও রেকর্ডিং — এইগুলিকে বিভিন্ন বিষয় ধরে সম্পাদনা এবং অনুবাদ করলে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার দর্শকদের সামনে পেশ করা যাবে।

সমস্যা হল কোথায় স্থাপনা করা যায় এত বিশাল সংগ্রহশালা। কলকাতায় কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি বিশাল ঐতিহাসিক বাড়িকে ধ্বংসের হাত থেকে অনেক কষ্টে বাঁচানো গেছে। একটি হল বিবিডি বাগের ওল্ড কারেন্সি বিল্ডিং, দ্বিতীয়টি ওই চত্বরে — মেটকাফ হাউস আর তৃতীয়টি হল আলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগারের পুরনো রাজপ্রাসাদ যার নাম ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি। দিল্লিতে সাংস্কৃতিক মন্ত্রকে কাজ করার সময় অর্থ মন্ত্রকের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করে এই তিনটের সম্পূর্ণ সংস্কারের জন্যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল। আর সে কাজ শেষ হল এই দু চার বছর আগে। আমার বিনীত মতে সাংস্কৃতিক মন্ত্রক ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির বিশাল এলাকাটিকে অপব্যবহার করছে আর ওল্ড কারেন্সি বিল্ডিংকেও অবহেলা করছে। রাজ্য সরকার কেন্দ্রকে আবেদন করে একটি অট্টালিকাও যদি কয়েক বছরের ব্যবহারের জন্যে অনুমতি জোগাড় করতে পারে তবে তো এই সংগ্রহালয় শুরু করা যেতেই পারে।

তত দিনের মধ্যে রাজ্য নিজের জায়গা ঠিক করে নিতে পারবে। আমি জানি না রাইটার্স বিল্ডিং কে নিয়ে কি পরিকল্পনা আছে। এই অট্টালিকার এক অংশে দুর্গা পূজা মিউজিয়াম ও বোধহয় করার কথা ভাবাই যেতে পারে। আরও অনেক কিছু করার আছে।

No comments on 'বিশ্বরাজালয় বিশ্ববীণা বাজিছে '

Leave your comment

In reply to Some User