ব্যাঙ্কগুলোর এই বিরাট ক্ষতির নেপথ্যে যেসকল ঋণখেলাপি কিংবা অর্থ আত্মসাৎকারী আছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিতে চলেছে?
পাঁচ মাস আগের ঘটনা। ১৬ জানুয়ারি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘হাউ ইন ফার্স্ট এইট ইয়ার্স ওব মোদি গভর্নমেন্ট, নিয়ারলি রুপিজ ১২ লাখ ক্রোর ডিসঅ্যাপিয়ার্ড।’ কীভাবে মোদি সরকারের প্রথম আট বছরে প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা উধাও হয়ে গেল। এই বিপুল অঙ্কের ১২ লক্ষ কোটি টাকার হিসাবে পৌঁছনো গিয়েছিল সংসদে সরকার তার ‘আট বছর সময়কালে’র মধ্যে পাঁচ বছরের যে হিসাব দিয়েছিল তার ভিত্তিতে করা গাণিতিক অনুমান বা extrapolation-এর সাহায্যে।
কিন্তু এখন আর বহির্পাতন ভিত্তিক অনুমানের প্রয়োজন নেই। গত ১৫ জুন কেন্দ্রীয় অর্থ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ড. ভাগবত কারাড চিঠি দিয়ে বিস্তারিতভাবে বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন। চিঠিতে ২০১৩-২০১৪ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত প্রতি বছরের সব ধরনের ব্যাঙ্কের (সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি) ক্ষতির সঠিক পরিমাণ উল্লিখিত। লক্ষণীয়, নরেন্দ্র মোদির জমানার আট বছর নয় মাস কালপর্বে ব্যাঙ্কগুলির অপূরণীয় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ লক্ষ ৯ হাজার ৬০৬ কোটি টাকায়। এই প্রথম অর্থমন্ত্রক লিখিতভাবে এই বিপুল অঙ্কের ক্ষতির কথা জানাল।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অদ্ভুত সার্কুলার
ব্যাঙ্কগুলোর এই বিরাট ক্ষতির নেপথ্যে যেসকল ঋণখেলাপি কিংবা অর্থ আত্মসাৎকারী আছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিতে চলেছে? এই প্রশ্ন তোলার আগেই গত ৮ জুন আমরা দেখলাম রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) একটা অদ্ভুত সার্কুলার জারি করে ব্যাঙ্কের ঋণখেলাপি অর্থ আত্মসাৎকারীদের আহ্বান জানাল বন্ধুত্বপূর্ণভাবে বিষয়টার নিষ্পত্তি করে নেওয়ার জন্য।
স্বাভাবিকভাবেই, ব্যাঙ্কের ইউনিয়নসমূহ, অর্থ বিশেষজ্ঞগণ এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক হইচই শুরু হল। কারণ, এরকম সার্কুলারের মাধ্যমে মোদি সরকার যে কেবল কুকর্মকারী অপরাধীদের আশীর্বাদ করছে তা নয়, ১২ লক্ষ কোটি টাকার মতো বিপুল অঙ্কের অর্থের গায়েব হয়ে যাওয়াটা নির্বাক প্রশ্রয়ে মেনে নিচ্ছে। সন্দেহ নেই, এটা স্বাধীনতা উত্তর ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ আর্থিক ক্ষতি।
৮ জুনের ওই বিতর্কিত বিজ্ঞপ্তির আগে অবধি আরবিআই নিয়মিত ব্যাঙ্কগুলোকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছে ঋণখেলাপিদের ব্ল্যাকলিস্ট করে তাদের শাস্তি প্রদানের জন্য। এ ধরনের শেষ নির্দেশিকা এসেছে ৭ জুন, ২০১৯-এ, সেটির ডিবিআর নং বিপি বিসি ৪৫/ ২১.০৪.০৪৮/২০১৮-১৯। সব ধরনের ঋণখেলাপিদের মধ্যে, আরবিআই-এর গাইডলাইন অনুসারে, সবচেয়ে বিপজ্জনক হল ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি বা Wilful defaulter-রা। আরবিআই তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার কথাই এতদিন বলে আসছিল। কারণ, এ ধরনের ঋণখেলাপি হল তারা যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দেনা পরিশোধ করে না কিংবা অর্থটা অন্য খাতে কাজে লাগায় অথবা অর্থটা তছরুপ করে যাতে অন্য কোনও সম্পত্তি থেকে সেটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না হয় অথবা ঋণগ্রহণকালে বন্ধক দেওয়া স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তিটি বিক্রয় করে দেয়।
একথা অনস্বীকার্য যে আরবিআই-এর আচরণ কাগুজে বাঘের মতো। আর ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা প্রতিদানে লাভের আশায় ঋণখেলাপি কুকর্মকারীদের প্রশ্রয়দাতা।
একথা অনস্বীকার্য যে আরবিআই-এর আচরণ কাগুজে বাঘের মতো। আর ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা প্রতিদানে লাভের আশায় ঋণখেলাপি কুকর্মকারীদের প্রশ্রয়দাতা। রাজনীতিকরা যেসব নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োগ করেছেন সেগুলো ঘুমন্ত আর ব্যাঙ্কগুলো এমন কর্পোরেট প্রশাসনিক ব্যবস্থার নিদ্রামগ্নতার সৌজন্যে উপদ্রুত। এমতাবস্থায় অসাধু শ্রেণি যে ধনীতর হয়ে উঠছে, তাতে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। বড় বড় মাথারা হিসাবের খাতায় জালিয়াতি করছে আর ব্যাঙ্কের অর্থ, জনগণের সঞ্চিত ধন গায়েব করে দিচ্ছে। মূলত সেই টাকায় তারা বিদেশে ফুর্তি করছে। সেখানে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। তারা নিঃসন্দেহে তাদের মদতদাতা, প্রশ্রয়দাতা, আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক মুরুব্বিদের সুবিধার স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে দিয়েই এরকম সুযোগ পেয়েছে। অন্যদিকে, ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা পূর্ণশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে অনাদায়ী ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে, ছোটখাটো উদ্যোগপতি কিংবা চাষির কাছ থেকে, যাঁদের ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ বড়জোর কয়েক হাজার টাকা এবং সেই ঋণ তাঁরা সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি।
পলাতক জালিয়াতদের সঙ্গে লেনদেন?
আশ্চর্য সমাপতন। গুজরাত থেকেই সাংসদ আমাদের প্রধানমন্ত্রী, আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর সেই গুজরাতের ভূমিপুত্র নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, নিশান্ত মোদি এবং অমি মোদি। এঁরা প্রত্যেকে একদা নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ রূপে পরিচিত ছিলেন। এঁরা সবাই মিলে ব্যাঙ্কের ১১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা লুঠ করেছেন। অঙ্কটা সুদের হিসাব ধরলে এখন ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এঁরা সবাই পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঋণদাতাদের কাছ থেকে ওই বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে সে টাকা আর ফেরত দেননি।
যতীন মেহতা প্রধানমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তিনিও আর একজন অর্থ তছরুপকারী। ২০১৪-তে তিনি সপরিবারে দেশ ছেড়েছেন। তার আগে তাঁর সংস্থা উইনসাম ডায়মন্ডস কমবেশি ৭,০০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। বলা বাহুল্য, এই অঙ্ক এখন সুদের হিসাবে ধরলে দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যাবে। আর একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা, স্টারলিং বায়োটেক লিমিটেড। এই সংস্থাটিও গুজরাত-ভিত্তিক। এটি ৮,১০০ কোটি টাকা প্রতারণারও সঙ্গে যুক্ত।
ব্যাঙ্ক ম্যানেজাররা বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে একটা কথাই জানিয়েছেন। ওই নীরব মোদি, মেহুল চোকসি কিংবা যতীন মেহতার ছবি তাঁরা দেখেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। জেনেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরকালে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন। ফলে, এঁদের ব্যাপারে কোনও সন্দেহ সংশয় ব্যাঙ্ক ম্যানেজারদের মনে উদয় হয়নি।
তবে ব্যাঙ্ক প্রতারকরা কেবল গুজরাতের মানুষ, এমন কথা আমরা বলছি না। কারণ, ওই তালিকায় আছেন মদ্য ব্যবসায়ী ও কিংফিশার এয়ারলাইন্সের মালিক বিজয় মালিয়া, যিনি স্টেট ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা লুঠ করেছেন। ওই তালিকায় আছে এবিজি শিপইয়ার্ড লিমিটেড, যার মালিক ঋষি কমলেশ আগরওয়াল ও আরও কয়েকজন, যাঁরা সবাই মিলে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা থেকে ২২ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা তছরুপ করেছেন।
এভাবে তালিকাটি আরও, আরও বড় করা যেতে পারে। নামের পর নাম সংযোজিত হতে পারে। আর এ ব্যাপারে দেউলিয়া ঘোষণার ব্যবস্থাপনা আর অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল।