সম্প্রতি দিল্লিতে রাজ্য বিধানসভার দু’জন সদস্য মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের উপস্থিতিতে রাজ্যের মুখ্যসচিবকে নিগ্রহ করেছেন। এই ঘটনার জেরে ওই দুই বিধায়ককে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের মুখ্য আধিকারিককে নিগ্রহ করার স্পর্ধা সত্যিই অভূতপূর্ব। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫১ নম্বর ধারা অনুযায়ী এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। কোনও সরকারি অফিসারকে হুমকি দেওয়া বা এমনকী ঠেলে দেওয়াও এই ধারায় অপরাধ। কিন্তু তাই বলে মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের সঙ্গে পরের মিটিংয়ে মুখ্যসচিব যে-ভাবে এক ডজন পুলিশ কর্মী— যাঁদের আনুগত্য কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতি— সঙ্গে নিয়ে আসেন, সেটা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমলাদের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতির প্রকাশ।
মনে রাখতে হবে, এ দেশে রাজ্যের মুখ্যসচিব নিয়োগের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে কিন্তু এই নিয়মটি খাটে না। এ ক্ষেত্রে আমলাদের কাজ কঠোর ও নিরপেক্ষ ভাবে যাচাই করা হয়। এখানে লক্ষণীয়, সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনগুলি দিল্লি সরকারের মুখ্য সচিবের হেনস্তার প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু দিল্লির লেফটেনান্ট গভর্নর যখন কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে এবং মুখ্যমন্ত্রীর অধিকার খর্ব করে মুখ্যসচিবকে নিয়োগ করেছিলেন, তখন তাঁরা কেউই কিছু বলেননি!
২০১৪ সালে কেজরীবাল দিল্লিতে মোদীর সুনামি থামিয়ে দিয়েছিলেন এবং আট মাসের মধ্যে দিল্লি রাজ্য থেকে কংগ্রেস ও বিজেপি, দুই জাতীয় পার্টিকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এই ঘটনা বিজেপি না কোনও দিন ভুলবে, আর না এ জন্য কেজরীবালকে ক্ষমা করবে। কিন্তু তাই বলে আইএসএস বা আইপিএস অফিসাররা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেজরীবালকে উৎখাত করতে উঠে পড়ে লাগতে পারেন না, সে তাঁর আচরণ যতই আপত্তিকর হোক না কেন। বহুত্ব এবং প্রাদেশিক বৈচিত্রকে সম্মান করাই এই যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ভিত। দিল্লি রাজ্যের এবং কেন্দ্রীয় সরকারের চালকরা একই ধরনের ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শরিক বটে, কিন্তু ভয় হয়, তাঁদের কুৎসিত ঝগড়া এক ধরনের ‘আইনি মর্যাদা’ পেয়ে যাবে এবং পরবর্তী কালে দেশে ভিন্ন ভাষা এবং ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে বিবাদ হলে এই সংঘাতকেই নজির হিসাবে ব্যবহার করা হবে।
দিল্লি আর পাঁচটা রাজ্যের মতো নয়। এই রাজ্য চলে সংবিধানের বিশেষ ধারা এবং গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল ক্যাপিটাল অব দিল্লি অ্যাক্ট (১৯৯১) অনুযায়ী। এই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের প্রশাসন যাতে নির্বিঘ্নে চলে, সেই উদ্দেশ্যেই এই দুই ধারা বা আইন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু প্রায়শই কেন্দ্রীয় সরকারের সুবিধার্থে বিধান দুটির একপেশে ব্যাখ্যা করা হয়, যে ব্যাখ্যা যুক্তরাষ্ট্রীয় সহাবস্থানের আদর্শকে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু সে যা-ই হোক না কেন, দিল্লি প্রশাসনের বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব পদে নিযুক্ত আইএএস এবং আইপিএস আমলারা রাজ্য সরকারের প্রতি তাঁদের কর্তব্য পালনে বাধ্য। এ কথা সত্যি এই আমলাদের নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার, কিন্তু এঁদের মধ্যে কেউই কি নেই যিনি ন্যায়ের পক্ষে গলা তুলে বলতে পারেন, কোনটা ঠিক? উত্তর ও মধ্য ভারতের অনেক জেলাশাসক এবং সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, এবং অবশ্যই তার মাশুল গুনেছেন। উত্তরপ্রদেশের দু’জন আইপিএস অফিসার প্রবল সাহস দেখিয়ে ক্ষমতাসীন দলের গুন্ডাদের গ্রেফতার করেছিলেন। আগ্রা ও সাহারানপুরের এই দু’জন এসপিকে সাম্প্রদায়িক গুন্ডারা হেনস্তা করে। ওরা তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয়ে পরিবারের ওপর হামলা চালায়, তাঁদের ভয় দেখায়। এবং অবশ্যই সরকার তাঁদের অন্যত্র বদলি করে দেন। কিন্তু ছেলেমেয়েদের কাছে এই দু’জন সত্যিকারের হিরো হয়ে থাকবেন। সম্প্রতি বরেলী’র জেলাশাসক এবং অমেঠির এসডিও-ও সাহস ও নিরপেক্ষতা দেখানোর জন্য ভুগছেন, কিন্তু নতিস্বীকার করেননি। দিল্লি প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের সিনিয়ররা কিন্তু এমন সাহস দেখাতে পারেন না, পাছে তাঁদের আন্দামানে বদলি হয়ে যেতে হয়।
অন্য দিকে, কেজরীবালের দাম্ভিক আচরণের কথা তো সবাই জানে, কিন্তু মোদী বা অন্য নেতারাই বা কী! আর সত্যি কথা বলতে কী, যে-সব রাজ্য সরকার কেন্দ্রের বিরোধিতা করে, তাদের টালমাটাল করে দেওয়ার রেওয়াজটা বহু প্রাচীন। এটা শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সালে, যখন নেহরু ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে গঠিত কেরলের কমিউনিস্ট সরকারকে বরখাস্ত করেছিলেন। পরে ইন্দিরা গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু আমলাদের আচরণ তাতে প্রভাবিত হবে কেন? গত ৪১ বছর পশ্চিমবঙ্গের গদিতে কেন্দ্রবিরোধী দল বা জোটই সরকার চালিয়ে আসছে, অথচ বহু আমলা কেন্দ্রে ও রাজ্যে সংবিধান মেনে তাঁদের কাজ সফল ভাবে করে গিয়েছেন।
একটি কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত হয়ে উচ্চ পর্যায়ের নানা মন্ত্রকে চাকরি করাটাই শেষ কথা নয়, বিভিন্ন টালমাটাল পরিস্থিতিতে অনড় থেকে সংবিধান মেনে কাজ করে যাওয়া এবং সেই সব পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে ঠিকঠাক মানিয়ে নেওয়াটাও এই চাকরির অন্যতম চাহিদা। ‘এক জন সামান্য রেভিনিউ সার্ভিস অফিসার’ যিনি চাকরি দিয়ে ছেড়েছেন— কেজরীবালকে এমন ভাবে সম্ভাষণ করার কোনও অধিকারই আমলাদের নেই। তিনি নির্বাচনে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। তিনি ধূর্ত এবং ঝামেলাবাজ, এই যুক্তিতে তাঁর বৈধ সরকারকে অবমাননা করার কোনও অধিকারই কারও থাকতে পারে না। এ দেশে আমলারা এর চেয়ে অনেক ঝামেলাবাজ, আরও বড় বড় মন্ত্রীদের সামলে এসেছেন। তাঁরা অনেক সময় উত্তেজিত জনতার মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন বিধায়করা। নেতার কোপে পড়ে বহু আমলাকে বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, যেমন এখন হাসপাতালের ডাক্তারদের ঝামেলার মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
আমলাদের বুঝতে হবে, মানুষের প্রত্যাশা এখন আগের চেয়ে বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। যা তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য, তা দেওয়া হবে না, দাবি করলে কিছু ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক নিয়মের কথা শোনানো হবে? এ জিনিস তাঁরা আর মানতে রাজি নন। তাঁদের মেনে নিতে হবে যে, গণতান্ত্রিক ভারতে ক্ষমতার পাল্লা এখন উলটো দিকে সরে গিয়েছে। আগে যা ছিল ইংরেজি-জানা উচ্চ বিত্ত ও অভিজাত আমলাদের দখলে, এখন তা চলে গিয়েছে পিরামিডের নীচের তলা থেকে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা সাধারণ মানুষের হাতে। তাঁরা তাঁদের মতো করে ভাবেন, চলেন, দাবি করেন যে, তাঁদের চাহিদা তৎক্ষণাৎ মেটাতে হবে। স্বভাবে ও আচরণে যতই মেঠো হন না কেন, এঁরাই কিন্তু সত্যিকারের ভারতের প্রতিভূ।