দেশের মানুষ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে তিনি মোটেই অপরিহার্য বা অজেয় নন। কট্টর সংঘ পরিবারও সেই বার্তা পেয়ে গেছে স্পষ্ট। নিজেকে তিনি যতই ঈশ্বরের বরপুত্র বলুন না কেন, যতই মসিহা হওয়ার চেষ্টা করুন না কেন তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি
মনে থাকবে। ১৯৬৭, ১৯৭৭ বা ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচন যেমন ইতিহাসে অন্যতম চাঞ্চল্যকর নির্বাচন হিসেবে স্থান পেয়েছে ঠিক তেমনই স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন। কোনও সন্দেহ নেই মোদি জামানার পরিসমাপ্তির সূচনা ঘটল এবারের নির্বাচনে। এই দেওয়াললিখন তাঁকে ভবিষ্যতে কতটা সতর্ক করবে তা ভবিষ্যতেই বলবে। ৩০৩ আসলে জেতা নিরঙ্কুশ নরেন্দ্র মোদির এবার ম্যাজিক ফিগার ছুঁতে পারেননি, এই বাস্তবতার ফল সুদূরপ্রসারী হওয়ারই সম্ভাবনা প্রবল। দেশের মানুষ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে তিনি মোটেই অপরিহার্য বা অজেয় নন। কট্টর সংঘ পরিবারও সেই বার্তা পেয়ে গেছে স্পষ্ট। নিজেকে তিনি যতই ঈশ্বরের বরপুত্র বলুন না কেন, যতই মসিহা হওয়ার চেষ্টা করুন না কেন তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও মোদি, তৃতীয় বারের জন্য এনডিএ সরকার গঠন করতে চলেছেন। তাঁর জোট সঙ্গীরা হয়তো সংখ্যার হিসেব তাদের আসন দিয়ে পুষিয়ে দেবে কিন্তু দরদাম করতে রেয়াত করবে না। রাজনীতি ও ব্যবসায় কোনও সমঝোতাই অনৈতিক নয়। কিন্তু সন্দেহ নেই, জোট সঙ্গীরা তাদের দাদাগিরি বজায় রাখবে, এতদিন যা মোদি-শাহের কুক্ষিগত ছিল। জোট সরকার মানেই তা ঠুনকো এবং ভঙ্গুর। ছোট দলের একটা টোকায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে পারে যখন তখন। আমরা অতীতে দেখেছি জ্যোতি বসু বা অটল বিহারী বাজপেয়ি জোট সরকার চালিয়েছেন নানাবিধ আপোস মীমাংসা করে। কখনও দল বা কখনও সংগঠনকে শরিক দলের চাহিদা ও মনোভাব মত চালনা করতে হয়েছে তাদের। গুজরাট জুটি মোদি শাহের কাজকর্মে আপোসের চিহ্নমাত্র নেই। তাই এই জোট সরকার টিকবে কিভাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। গত ৫ বছরে এই জুটি দেশের ৯ রাজ্যের সরকারকে কখনো টাকা, কখনো হুমকি, তাদের পেটোয়া রাজ্যপাল ও কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ব্যবহার করে অনৈতিক এবং অগণতান্ত্রিক উপায় ভেঙেছে কিংবা ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে। সেই বিরোধী রাজ্যগুলির গঠন করা ইন্ডিয়া জোট এবার বসবে বিরোধী আসনে এবং এই জুটির একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচার চুপ করে বসে দেখবে না। সেটাই স্বাভাবিক।
২০১৪-এর নির্বাচনে প্রথম জাতীয় স্তরে উত্তীর্ণ হওয়ার দু’বছর আগে থেকেই অত্যন্ত পেশাদারী কায়দায় মোদি হাওয়া উঠেছিল বা বলা ভালো হাওয়া তোলা হয়েছিল। একেবারে পয়সার বিনিময় পেশাদার সংস্থা মোদির প্রতিটি পদক্ষেপ স্থির করে। তিনি কীভাবে এবং কোন কথা বলবেন, কোথায় কখন কী পোশাক পরবেন, কীভাবে হাঁটবেন, কীভাবে বসবেন, এমনকি কীভাবে নমস্কার করবেন তাও ছিল স্ক্রিপটেড। ক্ষমতায় আসার পরও মোদি হাওয়া জিইয়ে রাখতে ওই সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করা হয়। ডিজিটাল মোদির ভারত তাদেরই ভাবনা। এবারই প্রথম সেই মোদি ম্যাজিক কাজে লাগলো না। রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য মোদির মিথ্যাচার, স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব এবং সর্বোপরি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণার রাজনীতি ব্যাকফায়ার করল। এমনই হল যে, উত্তর ভারতের হিন্দি বলয় যারা তথাকথিত হিন্দুত্বের সমর্থক তারাই মোদির ভাজপাকে প্রত্যাখ্যান করল।
দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এনডিএর সঙ্গে থাকা ওড়িশার নবীন পটনায়ক যখন বুঝলেন যে তার অন্যতম সঙ্গী ভাজপা সেই হিংস্র জাতের মাকড়সা, যারা নিজের সঙ্গীর মাংস খুবলে খায়, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অসুস্থ নবীন তাই ওড়িশা থেকে বিচ্যুত হলেন শুধুমাত্র মোদিদের বিশ্বাস করে। একই হাল হয়েছে তেলেঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও আর অন্ধ্রের জগনমোহন রেড্ডির।
তথাকথিত হিন্দি বলয়ের লোক নন নরেন্দ্র মোদি। তিনি পাশের গুজরাটের মানুষ। কিন্তু গুজরাটে পড়ে থাকলে চলবে না এই ভেবে তিনি আঁকড়ে ধরেন উত্তর ভারতের এই হিন্দি বলয়কে। লোকসভার প্রায় ৪৫ শতাংশ আসনকে পাখির চোখ করে হিন্দি শিক্ষা নিতে শুরু করেন। নিজেকে হিন্দি ও হিন্দুত্বের প্রাণপুরুষ প্রতিষ্ঠা করতে নিজের রাজ্য ছেড়ে প্রার্থী হন বারানসীতে। পাশাপাশি তার অপর লক্ষ্য ছিল অযোধ্যা। বাবরি মসজিদের ভগ্নাবশেষ-এর উপর রামের মন্দির প্রতিষ্ঠা করার মরিয়া চেষ্টায় নাবেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় মোদিকে তার লক্ষ্যে এক কদম এগিয়ে দেয়। কিন্তু পরিশেষে দেখা গেল রামলালা বা বাবা বিশ্বনাথ সদয় হননি। ২০২৪এর নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সবচেয়ে বড় ধাক্কা এল এই হিন্দি বলয় থেকে। এমনকি সমাজবাদী পার্টির কাছে অযোধ্যায় হেরে গেল মোদির দল। রামের নামে অনাচার মেনে নিতে পারলো না অযোধ্যার মানুষ। বারানসীতে মোদি জিতলেন বটে কিন্তু মার্জিন কমলো অনেকটা। ২০১৯ সালে তিনি জিতেছিলেন ৪ লক্ষ ৮০ হাজার ভোটে। এবার সেখানে মাত্র – দেড় লাখ। যে হিন্দি বলয়ের ভরসাতে তার দল ভোটে নেমেছিল – সেখানে মধ্যপ্রদেশ , উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশ ছাড়া কোনও রাজ্যই তাদের পক্ষে হাত উপুড় করেনি। গুজরাট অবশ্য মোদিকে বিমুখ করেনি। কিন্তু পাশাপাশি রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, আসাম বাদ দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাঁচটি রাজ্য এবং বাংলা তাকে স্পষ্টভাবে ক্ষমতা ত্যাগ করার রায় দিয়েছে। একই সঙ্গে যে এক্সিট পোল দাক্ষিণাত্যে মোদি ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়েছিল, বাস্তবে সেখানে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিপাত হয়নি।
বাংলায় এবারও মোদিকে একই রকম ভাবে আটকে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্ত্রীদের জেলে পাঠিয়ে, কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে, রাজ্যপালকে দিয়ে কুৎসা ও রাজ্য পরিচালনার বিভিন্ন পদে বাধার সৃষ্টি করে, টাকা দিয়ে মিডিয়া কিনে, ভোট প্রচারে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেও বাংলায় তৃণমূলে ভাঙ্গন ধরাতে পারেনি। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এনডিএর সঙ্গে থাকা ওড়িশার নবীন পটনায়ক যখন বুঝলেন যে তার অন্যতম সঙ্গী ভাজপা সেই হিংস্র জাতের মাকড়সা, যারা নিজের সঙ্গীর মাংস খুবলে খায়, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অসুস্থ নবীন তাই ওড়িশা থেকে বিচ্যুত হলেন শুধুমাত্র মোদিদের বিশ্বাস করে। একই হাল হয়েছে তেলেঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও আর অন্ধ্রের জগনমোহন রেড্ডির। একটু বেশি ভরসা করে এরা এনডিএ ছেড়ে যাননি। মোদ্দা কথা হল, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না নিয়ে শুধুমাত্র জোট সঙ্গীদের সঙ্গে সমঝোতা করে মোদি মোটেই পারবেন না আগের মত রোয়াব নিয়ে সরকার পরিচালনা করতে। সংসদের পরামর্শ না নিয়ে একের পর এক বিল পাস করিয়ে নিতে। গুজরাটি জুটির সাংগঠনিক দক্ষতা এক ছক্কায় মাঠের বাইরে ফেলে দিয়েছে বিরোধীরা। এবার ইন্ডিয়া যদি অতি সতর্কতার সঙ্গে খেলে এবং একটি বলও গলতে না দেয় তাহলে এই এনডিএ’র মুশকিল আছে। বলাই বাহুল্য, এখন সরকারি আমলারাও থাকবে খুব সতর্ক। কে কখন সরকারে থাকবে, মাথার উপর কখন কে বস হয়ে বসবে, তা অজানা। ফলে এতদিন এই গুজরাটি জুটি যেভাবে তাদের ক্ষমতার জোরে এই আমলাদের নিজেদের স্বার্থে অপব্যবহার করেছেন, এবার তা হওয়ার উপায় নেই। এটাই দেখার, এই পরিস্থিতি মোদি-শাহ জুটি কীভাবে সামলান।