বছর কয়েক ধরে দেখা যাচ্ছে যে দীপাবলী বা দিওয়ালির দু দিন আগে উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় রীতি অনুযায়ী ধনতেরাস পরব টি এখন এক শ্রেণীর বাঙালির কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ওদের পাঁচ দিনের লক্ষী ও কৃষ্ণকেন্দ্রিক অতি উজ্জ্বল দিওয়ালি আর আমাদের এক ঘোর অমাবস্যা রাত্রের কালীপূজার মধ্যে এমনিতেই প্রচুর পার্থক্য আছে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দিওয়ালি শুরু হয় ধনতেরাস দিয়ে। এটি কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর তিথি তে পালন করা হয় ধন ও ঐশ্বর্যের জন্যে, তাই ধনতেরাস বলা হয়। সেদিন নতুন বাসন, অলঙ্কার, ইত্যাদি কেনার একটা বাধ্যকতা আছে।
আর তার পর দিন ওদের ছোটি দিওয়ালি বা নরক চতুর্দশী আর আমাদের হল ভূত চতুর্দশী। তৃতীয় দিন বড়ি দিওয়ালি, আমরা অবশ্য কালী পূজো করি। তার পর দিন ওরা খুব ঘটা করে কৃষ্ণকে ছাপান্ন ভোগ খাওয়ায় ও গোবর্ধন পুজো করে যা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই । আর ওই পাঁচ দিনের অনুষ্ঠান শেষ হয় ভাই দুজ বা ভাইফোঁটা দিয়ে।
পুরাণ বলে শ্রী প্রতিষ্ঠার জন্য যে সমুদ্র মন্থন হয় তাঁর ফলে ১৪টি বিশেষ রত্ন পাওয়া যায়। তার চতুর্দশ ছিল অমৃত কলস যা নিয়ে আসেন ধন্বন্তরী। তার দু দিন পরে স্বয়ং মা লক্ষ্মী দেখা দেন তাই ধনতেরাসের দুদিন পর দীপাবলীতে প্রধানত লক্ষ্মীর পূজো হয়। আর একটি গল্প বলে যে বামন রূপী বিষ্ণু যখন তাঁর তৃতীয় পা রাজা বলির মস্তকে রাখেন আর পাতালে পাঠিয়ে দেন দেবতারা বলির ভয় থেকে মুক্তি পান আর একেই ধনতেরাস উৎসব হিসেবে পালন করা হয়।
পৌরাণিক কাহিনিতে উপদেশ অনুযায়ী ধনতেরাসের নিয়ম মেনে পূজো করলে আর দীপ দান করলে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা যায়। এই গল্পটি আবার অনেক খানি আমাদের মনসা মঙ্গলের মতন। হিম রাজার সন্তানের কপালে একটি অভিশাপ ছিল। সে নাকি বিয়ের চতুর্থ রাতে ঘুমিয়ে পড়লেই মারা যাবে। আর এই রাতটা ছিল ধনতেরাসের তিথি তে। পতিব্রতা স্ত্রী তাদের ঘরের বাইরে তার যত অলংকার ছিল সব এক ঢিপির করে রাখল। গভীর রাতে যখন যমরাজ সাপের রূপ ধারণ করে এলেন তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওই গয়নার স্তুপ আর জ্বলজ্বল করা মণি রত্ন দেখে। তিনি আর কক্ষে প্রবেশ করলেন না আর সারা রাত ধরে হিমরাজার পুত্রবধূর সহস্র গল্প শুনে কাটালেন আর ভোরে একাই ফিরে গেলেন। তাই এই ধনতেরাসের রাতে যত সোনা আর ধন রত্ন জোগাড় করা যায় ততই মঙ্গল আর শুভ।
আসল সত্যটি হল যে হিন্দু ধর্ম ধন অর্জন করাকে একটি বড় গুণ হিসাবে স্বীকৃতি দেয় আর চায় যে এর একটি অংশ ব্রাহ্মণ, মন্দির ও পূজার্চনায় খরচ হোক। এই উৎসবের সময় ব্রাহ্মণ, রাজা, জমিদারকে শস্য ও বিভিন্ন উপহার দেওয়ার রীতি ছিল। ধর্মীয় আচারে এই রীতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, এই কারণে, যাতে ব্যবসায়ী, কৃষক এবং সাধারণ গৃহস্থরা ঈশ্বর ও শাসককে তাঁদের প্রাপ্য দিতে না ভোলেন। অনেক অঞ্চলে ব্যবসায়ীরা হালখাতা শুরু করেন এই পুণ্য লগ্নে। দিওয়ালি এবং ধনতেরাসে গয়না আর বাসনপত্র কেনার যুক্তি হল ব্যবসায়ী ও কারিগররা যাতে নতুন ফসল থেকে প্রাপ্য আয়ের একটা অংশ পান। সেই জন্যই এই উপহার ও কেনাকাটার রীতি।
এমনকী এই সময় জুয়া খেলারও অনুমতি মেলে। যে ধর্ম লক্ষ্মী, কুবের ও গনেশের ছবি বা চিত্রের সামনে ‘শুভ লাভ’ লিখে মুনাফা পূজো করে সেখানে অবাক হবার কোন কারণ নেই। তাই অক্ষয় তৃতীয়া আর ধন ত্রয়োদশীর মতন অনুষ্ঠানে ক্রয় ও দান বিধি করা আছে বা ছিল। তাতে সমাজের মধ্যে ধনের সঞ্চালন হয় যা সকলের পক্ষেই লাভজনক। চাহিদা, উৎপাদন, বিক্রয় ও সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে সম্পূর্ণ অর্থনীতির উপকার হয়।
আশ্বিন-কার্তিক মাসে ফসল কাটার সময় লক্ষ্মীপুজো করার একটা যুক্তি রয়েছে। সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘লক্ষ্মীর অপর একটি নাম শ্রী। শ্রী নামটি এসেছে ল্যাটিন ‘সেরেস’ থেকে, যার অর্থ হল শস্যের অধিষ্ঠাত্রী’। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘শ্রী’র সমতুল্য ইন্দো-চিন ও ইন্দোনেশিয়ার দেবী ‘দেবী সিরি’র কথা লিখেছেন। সুকুমারী ভট্টাচার্য আরও বলেছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় এই শস্যের দেবীর উপাসনা করা হয়— দেবীমূর্তির হাতে এক গুচ্ছ শস্যের শীষ অথবা গ্রিক ‘কর্ন্যুকোপিয়া’ বা শস্যপাত্র। বাঙালি কিন্তু দিওয়ালির সময় ধুমধাম করে লক্ষ্মীর আরাধনা করে না। আগেভাগে দুর্গাপুজোর সাত দিন পর খুব শান্ত ভাবে এবং যথেষ্ট ছোট আকারে লক্ষ্মীপূজো সেরে নেয়।
এটা শুধু লক্ষ্মী কে নিয়ে নয়। আমাদের মানতেই হবে যে বাঙালি সব ব্যাপারেই আলাদা। যেমন, তারা পিতৃপক্ষ পালন করে মহালয়ার দিন, অথচ ভারতের অন্যান্য জায়গায় পিতৃপক্ষ পালিত হয় দীপাবলীর সময়। এমনকী বাঙালি কারিগররা তাদের যন্ত্রপাতির পূজো করে ফেলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বিশ্বকর্মা পূজোর দিন, অথচ বাকি রাজ্যে দুর্গাপুজোর দশমী কিংবা দিওয়ালির সময় যন্ত্রের পূজো হয়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে বাঙালি ক্রমশ সর্ব ভারতীয় রীতি মানতে শুরু করছে। যেমন গনেশ বা হনূমান কে পূজো করা । এর আগেও একটি সিনেমার প্রভাবে বাঙালিরা হঠাৎ সন্তোষী মা’র পূজো শুরু করল। তাতে অবশ্য আমরা আমাদের সংস্কৃতি ছাড়ি নি।
ধনতেরাসের প্রথায় হিন্দি ভাষীয় ও সংলগ্ন সভ্যতার ছাপ অনেক বেশি। হিন্দি সিনেমার প্রভাবে বাঙালি বিয়ের আগের দিন এখন আমরাও নাচ গানের ‘সংগীত’ নামক অনুষ্ঠানও অবলম্বন করছি। এখানে এখন কিছু বিবাহিত মহিলারা করওয়া চৌথের ব্রত পালন করা শুরু করেছেন। বিশ্বায়নের যুগে অনেকেই উঠে পড়ে লেগেছে ঐশ্বর্যের পূজোয়। আগে যারা বিপ্লব টিপ্লব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাত তাদের ও সবের জন্যে আর সময় নেই । অতএব ধনতেরাসে নিয়ম মেনে একটু সম্পদ বাড়ালেও বা ক্ষতি কি?