‘হিন্দিত্ব’ সংখ্যাগুরুদের মধ্যেই হিন্দি ভাষাকে গায়ের জোরে চাপিয়ে দিচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা কিছু নেই, হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ‘সরকারি ভাষা’ বলে গণ্য করা হয়েছে।
দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষেরা যখন হিন্দুত্বের উগ্র রূপ দেখে খুব বিব্রত হচ্ছিলেন তখন অনেকেই খেয়াল করেননি যে ‘হিন্দিত্ব’ হয়তো তার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর। ‘হিন্দিত্ব’ সংখ্যাগুরুদের মধ্যেই হিন্দি ভাষাকে গায়ের জোরে চাপিয়ে দিচ্ছে। আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রধান হিন্দুত্বের চেয়েও অধিক ক্ষতিকর এই ‘হিন্দিত্ব’। এর প্রবক্তারা বলেন যে, হিন্দি রাষ্ট্রীয় ভাষা তাই দোষ নেই, কিন্তু তা সত্যি নয়। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা কিছু নেই, হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ‘সরকারি ভাষা’ বলে গণ্য করা হয়েছে। অতএব এখন দিনরাত ওঁরা হিন্দি চাপিয়ে যাচ্ছেন, সে বিজ্ঞপ্তি বা কোনও নির্দেশেই হোক, বা সাইনবোর্ড, এমনকি পরীক্ষার সুবিধার্থে এবং ইন্টারভিউতেও। হিন্দিভাষীদের এই আধিপত্য বুঝতে গেলে এর ইতিহাসটিও একটু ফিরে দেখতে হবে।
১৯৩১ সালে অবিভক্ত ভারতের শেষ গ্রহণযোগ্য জনগণনায় দেখা গেল ৭.২ কোটি মানুষ ‘পশ্চিমি হিন্দি’ বলত (এর মধ্যে উর্দু বলার লোকও ছিল) আর ২.৮ কোটিকে বিহারি বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। দু’টি যোগ করলে প্রায় ১০ কোটি। ১.৪ কোটি রাজস্থানিকে পৃথক ধরা হয়েছিল। তখন বাঙালির সংখ্যা ছিল ৫.৩ কোটি। স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর হঠাৎ ১৯৫১-র জনগণনায় হিন্দি, উর্দু, পঞ্জাবি, বিহারি ও রাজস্থানি মিলিয়ে ১৫ কোটি দেখানো হল, বাঙালি কমে হল মাত্র ২.৫ কোটি। আশ্চর্যের ব্যাপার, ১৯৬১ ও ২০১১-র গণনার ব্যবধানে হিন্দি বলার লোকের সংখ্যা ভারতবর্ষে ৩০.৩৯ শতাংশ থেকে ৪৩.৬৩ শতাংশে বেড়েছে। এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির কারণ হল, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের প্রচুর পৃথক ভাষা ও উপভাষাকে হিন্দির আয়ত্তে আনা হয়েছিল। ১৯৬১-তে দশটি মাতৃভাষাকে হিন্দি বলে গণ্য করা হয়েছিল। তার মধ্যে অওধি, ব্রজভাষা, বাগেলখান্ডি, বুন্দেলখান্ডি, ছত্তীসগঢ়ি, খড়িবোলি-ও ছিল। ১৯৭১-এ ৪৮টি ভাষাকে হিন্দি বলে চিহ্নিত করা হল। এর মধ্যে যোগ হল ভোজপুরি, বানজারা, গাড়োয়ালি, কুমাওনি, গোজরি, পাহাড়ি, সদ্রি ও আরও কিছু ভাষা। এই ভাষাভাষীদের মধ্যে অনেকেই সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন যে তাঁদের পৃথক স্বাধীন ভাষার মর্যাদা দেওয়া হোক, কিন্তু আজ অবধি তার কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এই সব ক’টি মিলিয়ে দাঁড়াবে ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১৫-২০%। যদি এঁদের আবেদন ধার্য হয় তা হলে হিন্দির ভাগ কমে গিয়ে ৪৩.৬% থেকে হয়ে যাবে ২৫%-এর কাছাকাছি।
চাকরির সুবিধার জন্য অনেক অ-হিন্দিভাষী লোকেরাও নিজেদের হিন্দিভাষী বলে পরিচয় দিতে লাগলেন। হিন্দিবাদীরা সংবিধানের ৩৫১ নম্বর ধারা দেখান, যেখানে হিন্দির সমৃদ্ধির কথা বলা আছে। তা সত্যি হলেও কিন্তু সংবিধানে অ-হিন্দি ভাষার সংরক্ষণের দায়িত্বেরও উল্লেখ আছে। দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে গত দশক ধরে যখন থেকে হিন্দির ব্যাপক বৃদ্ধির রাজনৈতিক মুনাফা প্রকট হয়ে উঠেছে।
সঙ্গে সঙ্গে এটাও দেখা যাচ্ছে যে, এই বিশাল হিন্দি এলাকার মানুষ সবচেয়ে কম শিক্ষিত। আর তাঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এতই পিছিয়ে যে, অর্থনীতিবিদরা এই রাজ্যগুলিকে ‘বিমারু’ বা জরাগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করেছেন। ভারতের অন্য সব রাজ্য যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয়েছে, এই পিছিয়ে থাকা হিন্দি রাজ্যগুলি তা একেবারেই পারেনি। তাতে এই রাজ্যগুলির লোকসংখ্যা বেড়েই চলছে। হিন্দির এই নিরন্তর বৃদ্ধির ফলে ভারতের অন্য ভাষার তুলনামূলক অংশ বা হার প্রতি দশকে কমে চলেছে। এই নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচুর ক্ষোভের সৃষ্টি ও সঞ্চার হচ্ছে। একমাত্র বাংলা তার ৮.২ শতাংশ স্থান বজায় রাখতে পেরেছে— তাই বঙ্গবিরোধীরা ক্রমাগত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের ঘণ্টা বাজাতে থাকে। বাংলা ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে বরাবরই দ্বিতীয় স্থান রাখতে পেরেছে বলে বেশ কিছু লোকের জ্বালা হয়। কিন্তু এখন বাংলা মাত্র ১০ কোটির ভাষা। তাই অস্বীকার করা যায় না যে বর্তমানে বাংলা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার মতো আর একটিতে পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক কারণে এখনও এ দেশের মানুষ বাংলা আর তামিলকে যথেষ্ট সম্মান দেয়। আঞ্চলিক ভাষাদের সুরক্ষা আর যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা রক্ষার নেতৃত্বের স্থানও এদেরই।
গাঙ্গেয় উপত্যকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক বিশাল শ্রেণির মানুষকে হিন্দি ছাড়া আর কোনও ভাষা খুব একটা শিখতে হয়নি। অন্যান্য রাজ্যে শিক্ষিতদের কমবেশি তিনটি ভাষা জানতে হয়: মাতৃভাষা, ইংরেজি ও হিন্দি। তাতে তাঁরা অন্যদের সংস্কৃতি ও চিন্তাভাবনা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারেন।
সংখ্যা ছেড়ে বাস্তব দেখা যাক। প্রায় সতেরো বছর দিল্লিতে কাজ করার সময় দেখতাম সকলেই ইংরেজি আর হিন্দি মিশিয়ে কথা বলত। এতে কোনও অসুবিধে হত না, আর তখন ওই হিন্দির মধ্যে কোনও অহঙ্কার দেখিনি। কিন্তু আমার মেয়াদের শেষ আড়াই বছর বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, সব বদলাতে শুরু করেছে। সব ব্যাপারে একটা ইচ্ছাকৃত হিন্দির দাপট শুরু হল। বুঝলাম ওঁদের বেশির ভাগ মন্ত্রী হিন্দি দুনিয়ার মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন, আর এর বাইরের জগৎকে হিন্দি সঙ্কীর্ণতার দৃষ্টি থেকেই দেখেন।
সত্যি কথা হল, গাঙ্গেয় উপত্যকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক বিশাল শ্রেণির মানুষকে হিন্দি ছাড়া আর কোনও ভাষা খুব একটা শিখতে হয়নি। অন্যান্য রাজ্যে শিক্ষিতদের কমবেশি তিনটি ভাষা জানতে হয়: মাতৃভাষা, ইংরেজি ও হিন্দি। তাতে তাঁরা অন্যদের সংস্কৃতি ও চিন্তাভাবনা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু হিন্দি-ক্ষেত্রে গত কয়েক প্রজন্ম ধরে শুধু হিন্দি জানলেই দিব্যি চলে। আগে তাঁদের অনেকেই ইংরেজি না জানায় বা খুব কম জানার কারণে কিঞ্চিৎ লজ্জা বোধ করতেন। কিন্তু নতুন হিন্দিবাদী শাসকদের যুগে এই ভাষাটিকে ঔপনিবেশিক ও ঘৃণ্য বলে চিহ্নিত করাই ধিক্কারের লক্ষ্য। ভারতের অন্য কোনও ভাষাভাষীর সংস্কৃতি বা চিন্তাধারা তাঁদের জানতেও হয়নি, ফলে এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অতি সীমিত। একমাত্র তামিলনাড়ুতে তাঁরা বাধা পেয়েছেন, তা ছাড়া অন্যান্য রাজ্যে ভাঙা, ব্যাকরণবিরুদ্ধ হলেও হিন্দিতেই জবাব শুনেছেন। এই সুবিধাটি তাঁরা ক্রমশ একটা অধিকার ও অহঙ্কারে পরিণত করেছেন।
এই হিন্দিত্ব-র সঙ্গে হিন্দুত্বের অনেক মিল থাকলেও দু’টি বেশ খানিকটা আলাদা। হিন্দুত্ব বা উগ্র হিন্দুত্ববাদের শিকড় অসম ও কর্নাটকে যথেষ্ট গভীর, যদিও ওখানকার বাসিন্দারা সাধারণত হিন্দিতে কথা বলেন না। প্রচুর লোক আছেন যাঁরা এক বর্ণ হিন্দি বলতে পারেন না। কিন্তু তাঁরাও অন্ধভক্তিতে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেদের গালাগালি করেন। অবশ্য এও দেখা গেছে, সাধারণত ভাষা, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, পারিবারিক পরিবেশ ও শিক্ষার সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক আছে। বাংলার নবজাগরণ, তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় সত্তার আন্দোলন আর কেরলের শিক্ষার প্রচারের ফলস্বরূপ এ সব রাজ্যের বহু মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে চিন্তা করেন। এক দিকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের বাণীর প্রভাবে বাঙালি যতটা উদার হল, উত্তর ভারতে আর্য সমাজ ও গুজরাতে স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ের প্রচারে তাঁদের হিন্দুধর্মের মধ্যে কিছু গোঁড়ামিও ঢুকল।
শুনে অবাক হলাম, এখন গুরুত্বপূর্ণ স্তরের ইউপিএসসি পরীক্ষাতেও সফল প্রার্থীদের মধ্যে প্রতি বছর ৫০০ থেকে ১০০০ হিন্দিতে পরীক্ষা দিচ্ছেন, অন্যান্য ভাষার প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। কেন্দ্রীয় সরকারের স্টাফ সিলেকশন বা অন্য পরীক্ষায় নাকি একচেটিয়া হিন্দির জয়। প্রচুর পরীক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ও হিন্দি ছাড়া অন্য কোনও ভাষার সুযোগ নেই। ফলে হিন্দিভাষীদের সংখ্যা সব চাকরি বা প্রশাসন-পুলিশ আর ব্যবসায়— অর্থনীতিতে তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। আর এই রাজনীতিতে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁদের দম্ভ এমন বেড়েছে যে, ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলিকেও এখন ওঁরা হিন্দিকরণ শুরু করেছেন। যেখানে বর্তমান লোকসভায় ৫৪৫ জন সদস্য, নতুন সংসদ ভবনে ৮৮৮টি আসন রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার আর হিন্দি রাজ্যরা চায় হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যাটি সোজাসুজি সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পরিণত হোক, যাতে তারাই চিরকাল শাসন করতে পারে। এর বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি তীব্র প্রতিবাদ করেছে। তাদের বক্তব্য, যে সব প্রগতিশীল রাজ্য পরিবার পরিকল্পনায় সফল হয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাদের সাজা দেওয়া হচ্ছে। আর যারা ক্রমাগত অনগ্রসরতার পরিচয় দেখিয়েছে, তাদের পুরস্কৃত করে তাদের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি সকলের উপর জোর করে চাপানো হচ্ছে।
ভারতের ৫৬ শতাংশ মানুষ হিন্দি অঞ্চলের বাইরে থাকা সত্ত্বেও এক গোঁড়া হিন্দিবাদী শ্রেণি এখন বহুত্ববাদকে নির্মূল করতে শুরু করেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না, এবং ভারতের বৈচিত্র আর আঞ্চলিক সভ্যতাকে হিন্দি-হিন্দু রামরাজ্যের পথে এক বড় বাধা বলে মনে করে।