কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক সংসদে প্রশ্নের জবাবে এমন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কিছু সংখ্যা পরিসংখ্যান প্রদান করছে যে তার থেকে পুরো চিত্রটা অনুধাবন করা সহজ নয়। তাই আমরা ঠিক করেছি দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী ঋণের দায়ে ব্যাঙ্কগুলো ক্ষতির বিষয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও এই দফতরের প্রতিমন্ত্রী যেসব কথা সংসদে বলেছেন, সেগুলো একত্রিত করে পরিবেশন করব। আমরা আবিষ্কার করেছি ১২ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্কগুলো থেকে সরানো হয়েছে এবং এই কম্মটি করেছেন মূলত বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো। এই অপকর্মটি তাঁরা করেছেন নরেন্দ্র মোদির শাসনকালের প্রথম আট বছরেই। এই কাজটি তাঁরা করেছেন রীতিমতো আইনসম্মতভাবে ঋণ নিয়ে এবং পরবর্তীকালে সেই অর্থ অনাদায়ী অনুৎপাদক সম্পদ (নন পারফরমিং অ্যাসেট বা NPA) হিসেবে হিসেবের খাতা থেকে মুছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
অনুৎপাদক সম্পদ বা NPA বলতে বোঝায় সেই সব সম্পত্তিকে যা ৯০ দিনের বেশি সময় ধরে আয় দেয় না বা যার থেকে কোনও আয় আসে না। ৯০ দিন পর ব্যাঙ্কগুলোকে এ ধরনের সম্পত্তির বিষয়ে সতর্ক করা হয় আর তার পর তারা দরাদরি করে ঋণ কাঠামো অদলবদল করার জন্য। এটা তখনই সম্ভব হয় যখন ঋণগ্রহীতা নীরব মোদি, মেহুল চোস্কি, নিশান্ত মোদি এবং অমি মোদির মতো ব্যাঙ্কের অর্থ নিয়ে চম্পট দেয় না। এঁরা সকলেই কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বিদেশ সফরকালে তাঁর সঙ্গী ছিলেন। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ও অন্যান্য বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে এই সকল জালিয়াতরা ১১,৪০০ লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে আর ব্যাঙ্কগুলো তাঁদের আটকাতেও পারেনি।
প্রধানমন্ত্রীর অপর একজন গুজরাতি বন্ধু উইনসাম ডায়মন্ড-এর যতীন মেহতা ৭,০০০ কোটি টাকা নিয়ে লন্ডন চম্পট দিয়েছেন। নীরব মোদি আর মেহুল চোস্কি বিদেশে বিলাসবহুল জীবন কাটাবে বলে দেশত্যাগ করায় সিবিআই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার পর দাবি করে যে ওই দুজন মিলে ভারতীয় ব্যাঙ্কের ৩০টি বিদেশি শাখা থেকে প্রায় ৬,৭০০ কোটি টাকা তছরুপ করেছে। গুজরাত-কেন্দ্রিক সংস্থা স্টার্লিং বায়োটেক অন্ধ্রব্যাঙ্কের ৮,১০০ কোটি টাকা তছরুপ করেছে। নীতিন সন্দেসারা ও তাঁর পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার পরেও তারা নাকি কোথাও পালিয়ে গিয়েছে! এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, একমাত্র বিজয় মাল্য ছাড়া আর সব ক’টি বড় বড় ঋণখেলাপিরা গুজরাতের এবং তাঁরা সকলেই প্রধানমন্ত্রীকে ভালমতো চিনতেন। একমাত্র বিজয় মাল্য গুজরাতভিত্তিক ব্যবসায়ী ছিলেন না এবং তাঁর ঘটনাটি ইউপিএ জমানায় ঘটেছিল। ভারতের বৃহত্তম জালিয়াতির মামলাটিও একটি গুজরাটি সংস্থার বিরুদ্ধে। সংস্থাটির নাম এবিজি সিপইয়ার্ড। সংস্থাটি স্টেট ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য ২৭টি ব্যাঙ্কের ২২,৮২০ কোটি টাকা লুঠ করেছে।
এরকম সরাসরি লুঠ, যেখানে ব্যক্তি ও অর্থ দুই-ই উধাও, তেমনটা ছাড়াও আরও অনেক ঋণগ্রহীতা আছেন যাঁরা ব্যাঙ্কের প্রভূত আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়েছেন। বহুক্ষেত্রে প্রোমোটাররাই নিজেদের ইউনিটগুলো থেকে ঘুরপথে নিজেদের লগ্নীকৃত অর্থই সরিয়েছেন। এঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত এবং বহুক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার সুবাদেই তাঁদের ঋণপ্রাপ্তি। আনুকূল্য আনুকূল্যের জন্ম দেয় এবং এইসব অনুৎপাদক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য উদ্যোগপতিদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তাঁদের কেউ শাস্তি দিতে পারবে না। এ-সংক্রান্ত আইনগুলোকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে আর তার ফলস্বরূপ অনুৎপাদক সম্পদ বেড়েই চলেছে।
সব ক’টি ক্ষতির মুখে পড়া সংস্থা কিংবা অনুৎপাদক সম্পত্তি (NPA) ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি হয়েছে তা কিন্তু নয়। কয়েকটির ক্ষেত্রে ক্ষতির প্রতিবিধান করা সম্ভব ছিলও না। এ-জন্যই গোটা দুনিয়ায় প্রদত্ত ঋণের ১ থেকে ২ শতাংশ অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হবে, এমনটা ধরেই নেওয়া হত। এটাকেই সাধারণভাবে অনুৎপাদক সম্পদ অনুপাত বলা হয়। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের ২০২১-এর প্রতিবেদন অনুসারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য (UK) এবং অধিকাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে এই অনুপাত ১.১ থেকে ১.২ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এর কারণ ওই দেশগুলোতে অর্থনীতিক ও ফৌজদারি আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয় এবং আর্থিক বেনিয়মের ঘটনা সামনে আসায় বহু সরকারের পতন ঘটেছে। কানাডায় এনপিএ অনুপাত ০.৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়াতে এই অনুপাত ০.৫ শতাংশ এবং সুইজারল্যান্ডে তা ০.৬ শতাংশ। চিনে অর্থনৈতিক অপরাধ কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হয় এবং সে-দেশে এই অনুপাত মোটে ১.৮ শতাংশ। রাশিয়াতে এই অনুপাত ৮.৩ শতাংশ আর আমরা প্রত্যেকেই জানি যে রাশিয়ার বর্তমান শাসকপক্ষটি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পেটোয়া পুঁজিপতিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ যার সুবাদে তারা জনগণের সম্পদ অবাধে লুটপাট করতে পারে।
আর, ভারতের অবস্থাটা কীরকম? রাজ্যসভায় আমার এ-বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে গত ১৩ ডিসেম্বর, ২০২২-এ অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন সব ব্যাঙ্ক মিলিয়ে মোট অনুৎপাদক সম্পত্তি (NPA)-র অনুপাত ৩১.০৩। ২০১৪-তে ছিল ৪.১ শতাংশ (এটা হল ইউপিএ জমানার শেষ পাদের হিসাব)। এই অনুপাত ৩১.০৩.২০১৮-তে বৃদ্ধি পেয়ে ১১.৪৬ শতাংশ হয়। অপর একটি প্রশ্নের জবাবে অর্থ দফতরের প্রতিমন্ত্রী জানান যে, বিগত সাত বছরে এই অনুপাত সর্বাধিক বৃদ্ধি পেয়ে ১২.১৭ শতাংশ হয়েছে। মোট অনুৎপাদক সম্পত্তির অনুপাত ৩১ মার্চ, ২০২২-এ কমে ৫.৯ শতাংশ হলেও ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৬.৫ শতাংশ পৌঁছয়। ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২-এ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে অনুমিত হয় যে ২০২৩-এর সেপ্টেম্বর নাগাদ ভারতের রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাঙ্কসমূহের অনুৎপাদক সম্পত্তির অনুপাত বেড়ে ৯.৪ শতাংশ হবে। এমনকী বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিও বিপদে পড়বে। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক গড়ের তুলনায় ভারতের অনুৎপাদক সম্পত্তির অনুপাত ৪-৫ গুণ বেশি, এদেশের অবস্থা রাশিয়ার চেয়েও খারাপ।
সরকার তারপর লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে বাধ্য করে হিসাবের খাতায় ক্ষতি দেখাতে, কারণ ব্যাঙ্কগুলোর উদ্বৃত্ত আয় তো অনুপাদক সম্পদ গিলে খেয়েছে। যে ব্যাঙ্কগুলো বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার মুনাফা অর্জন করেছে সেগুলোই ২০১৫-’১৬ থেকে ২০১৯-’২০, মোদি জমানায় এ বছরে ২০.৭৩ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতির শিকার হয়েছে স্রেফ অনুৎপাদক সম্পদের কারণে। স্বয়ং অর্থমন্ত্রীও তো সংসদে উত্তরদান কালে বলেছেন ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পত্তির পরিমাণ ২০১৪-র মার্চে ছিল ২.৫১ লক্ষ কোটি টাকা, সেটা ৩১ মার্চ। ২০১৪-তে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৯.৬৩ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোদি জমানার চার মাসে অনুৎপাদক সম্পত্তির পরিমাণ চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি কেন্দ্রে আসীন বর্তমান শাসক পক্ষের ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণের পক্ষে একেবারে মোক্ষম যুক্তি হয়ে উঠতে পারে। ব্যাঙ্কের কর্মচারী ইউনিয়নগুলো অবশ্য এসব তথ্য নিয়েই লড়াইয়ে নেমেছেন। তাঁরা বলছেন, জনগণের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ উধাও হয়েছে এটা যেমন সত্যি তেমনই সেই অর্থ অন্যের পকেটে জমা হয়েছে, এটাও অনস্বীকার্য।
সমস্যার সূত্রপাত দ্বিতীয় ইউপিএ আমলে (২০০৯-’১৪) যখন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী, যিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ও অর্থনীতিবিদও বটে, সেই মনমোহন সিং অনুৎপাদক সম্পদ খাতে ১.৯৩ লক্ষ কোটি সরিয়ে রাখার সংস্থান করেছিলেন। তখন অনুৎপাদক সম্পত্তির অনুপাত ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করত। মোদি জমানায় ২০১৫-’১৬ থেকে ২০১৯-’২০-র মধ্যে পাঁচ বছরে ব্যাঙ্কগুলোকে অনুৎপাদক সম্পত্তিতে পাঁচগুণ বেশি ঋণ কার্যত বাধ্য করা হয়। অনুৎপাদক সম্পত্তির জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ সংস্থান করা হল, এই সংস্থানের পরিমাণ ১০.১৬ লক্ষ কোটি টাকা। পূর্ববর্তী জমানায় প্রদত্ত কুঋণের দায় খানিকটা এনডিএ জমানার শুরুতে এসেও পৌঁছেছিল। কিন্তু এখন যখন মোদি-শাসনের নয় বছর অতিক্রান্ত, এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি আর ক্ষতিকারক ঋণ প্রদানের বড় অংশগুলোর জন্য দায় বর্তমান জমানার শাসক শিবিরের বন্ধু কর্পোরেট সংস্থাগুলো এবং বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সমূহের।
মোদি শাসনের আট বছরে (২০১৪-’১৫ থেকে ২০২১-’২২) সরকারি-বেসরকারি সকল ব্যাঙ্ক মিলিয়ে সরকার কর্তৃক ঘোষিত অনুৎপাদক সম্পদের মোট পরিমাণ ৬৬.৫ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু এই আট বছরে ঠিক কত টাকা অবলোপন করা হয়েছে সে-তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু হাতে যে উপাত্ত মজুত আছে সেটার ভিত্তিতে বলা যেতেই পারে, মোদি জমানায় প্রথম আট বছরে ১৪.৫ লক্ষ কোটি টাকার অবলোপন ঘটানো হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের অবলোপন ঘটানোর পরেও ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৩ শতাংশ অর্থ উদ্ধার এখনও সম্ভব এবং এই তথ্য খোদ অর্থমন্ত্রক কর্তৃক প্রদত্ত। যদি ধরেও নিই যে অবলোপন করার পরেও সে অর্থের ২০ শতাংশ পরে উদ্ধার করা সম্ভব হবে, তা হলেও মানতেই হচ্ছে যে মোদি জমানার প্রথম আট বছরেই ১২ লক্ষ কোটি টাকা বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আধডজন রাজ্যের বার্ষিক রাজস্ব আয় ও বাজেটের মোট আর্থিক পরিমাণের চেয়ে বেশি।
তবে বিপুল পরিমাণ যে অর্থ চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল তার বেশিরভাগটাই সাধারণ আমানতকারীদের টাকা এবং আমাদের মতো ক্ষুদ্র লগ্নিকারীদের টাকা। আর কিছুটা ব্যাঙ্কের আয়ই ব্যাঙ্ক খেয়েছে। বোফর্স কেলেঙ্কারির আর্থিক পরিমাণ ছিল ৬৪ কোটি টাকা আয় এই ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারিতে উধাও হয়ে গিয়েছে ১২ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রকের সাম্প্রতিক জবাব থেকেই জানা যাচ্ছে যে, ইউপিএ জমানার দু’দফায় সিবিআই ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত ৪৮৬ জন ব্যক্তিকে জেরা করতে পেরেছিল আর মোদি জমানায় প্রথম দফায় সিবিআই তদন্তের মুখে পড়েছেন মাত্র ৫৯ জন! এ-বাবাদ আদায়ীকৃত জরিমানার পরিমাণও প্রায় ১৫ কোটি টাকা থেকে কমে মোটে এক কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে!
তুচ্ছ অর্থনৈতিক অপরাধের জন্য ফৌজদারি পদক্ষেপ করা যায়। সেখানে যারা জনগণ ও সরকারি সংস্থার লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বেমালুম গায়েব করে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার তেমন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী নন। ব্যাপারটা মোটেই ভাল ঠেকছে না।