তাঁর আসল উদ্দেশ্য হল যে ভাবেই হোক না কেন তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় তোলা এবং সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বাসনা হল—পরে যেন এই অট্টালিকাটি তাঁরই নামে পরিচিত হয়।
শোনা যাচ্ছে যে আগামী ২৮ মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি চকচকে নতুন সংসদ (New Parliament) ভবন আমাদের উপহার দেবেন। অবশ্য, আমরা কখনও এটি চেয়েছি বলে কেউ মনে করতে পারছি না। তা সত্ত্বেও তিনি দেশবাসীর দেওয়া আয়কর আর জিএসটির ১২০০ কোটি টাকা খরচ করে এই ত্রিকোণ গৃহটির উদ্বোধন করার জন্যে ছটফট করছেন।
তাঁর আসল উদ্দেশ্য হল যে ভাবেই হোক না কেন তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় তোলা এবং সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বাসনা হল—পরে যেন এই অট্টালিকাটি তাঁরই নামে পরিচিত হয়। তবে আমাদের প্রথম প্রশ্ন হল— ভবনটি যদি সাংসদদের জন্যে নির্মাণ করা হয়ে থাকে তবে একজন সাংসদকেও জিজ্ঞেস করা হল না কেন তাঁদের প্রয়োজন আছে কি না বা তাঁরা আদৌ এটি চান কি না। গত তিন বছর ধরে ৭৮৮ জন সাংসদের চোখের সামনে, সত্যি বলতে কী তাঁদের নাকের ডগায়, এই বিশাল প্রাসাদের কাজ খুবই জোরকদমে কোলাহল করে চলতে থেকেছে। কিন্তু কাউকে কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ বা অধিকার দেওয়া হয়নি। এমনকী সাংসদ হিসাবে আমি প্রতি অধিবেশনে, প্রতি সপ্তাহে এ-বিষয়ে সরকারকে প্রচুর প্রশ্ন করা সত্ত্বেও কোনও দুর্বোধ্য কারণে তার একটিও উত্তরের যোগ্যতা অর্জন করেনি। এটি মোদি জামানার নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের এক মোক্ষম উদাহরণ।
অতএব সরকারের দাক্ষিণ্যে যে ক’টি ছবি আর মানচিত্র পাওয়া গেছে তা থেকে যা অনুমান করা যাচ্ছে তার ভিত্তিতে খুবই স্পষ্ট যে নরেন্দ্র মোদি আর একটি প্যাঁচালো চাল চেলেছেন। সংসদের দুই সভাকক্ষেরই আয়তন অপ্রয়োজনীয় ভাবে বাড়িয়ে মোদি আসলে সংসদের মান আরও খর্ব করারই চেষ্টা করছেন। টিভিতে মনে হবে দুটি কক্ষই কত খালি। একটু বিশদ করে বলা প্রয়োজন। পৃথিবীর কোনও সংসদের সভাকক্ষ নেই যা দেখলে একটু খালি খালি লাগে না। এর প্রধান কারণ হল যে সাংসদদের কাজ শুধু স্কুলের ছাত্রের মতন কক্ষে বসে থাকা তো নয়। তাঁরা প্রতি মুহূর্তে আঁচ করার চেষ্টা করেন অন্য দলগুলি কী ভাবছে বা তারা কী করতে চলছে। এর উপরে নির্ভর করে তাঁরা বা তাঁদের দল কী অবস্থান নেবে, অন্তত সংসদের মধ্যে। এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি চলে ক্রমাগত আর অবিচ্ছিন্নভাবে।
সংসদের দুই সভাকক্ষেরই আয়তন অপ্রয়োজনীয় ভাবে বাড়িয়ে মোদি আসলে সংসদের মান আরও খর্ব করারই চেষ্টা করছেন
তাই স্বাভাবিকভাবে একটু বরিষ্ঠ নেতা হলেই তাঁকে অন্যান্য দলের নেতা বা অন্য সাংসদদের সঙ্গে সব সময় কথাবার্তা ও আলোচনায় থাকতে হয়। সভার মধ্যেই ফিসফিস করে কথা বললে চলে, কিন্তু তাতে অন্যরা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হন। অতএব অনেকেই বেরিয়ে এসে সেই বিখ্যাত ‘লবি’তে দাঁড়িয়েই আলোচনা করেন। এ-ছাড়া বেশ কয়েকজন সাংসদ বিভিন্ন সংসদীয় কমিটি বৈঠকে ব্যস্ত থাকেন। সব মিলিয়ে তিরিশেরও বেশি কমিটি আছে আর অধিবেশনের সময় বৈঠক ডাকলে সাংসদদেরও পাওয়া যায়। অতএব টিভিতে সংসদের কক্ষগুলি এখনই অর্ধেকের বেশি খালি দেখায়। আর নতুন ভবনের বিশাল জায়গার মাঝে মোদির টিভি ক্যামেরা দেখাবে যে সাংসদেরা ‘ক্লাস ফাঁকি’ দিচ্ছেন। এমনিতেই তিনি আসার পর সংসদের অধিবেশনের দিন প্রায় ৪০ শতাংশ কমিয়ে এনেছেন আর তারপর অফুরন্ত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন যে ওঁরা অর্থাৎ বিরোধীরা শুধুই প্রতিবাদ করেন, ‘কাজ করেন না’।
মোদির অনিষ্টজনক পরিকল্পনার কোনও শেষ নেই। সভাকক্ষ বড় করলেও অধ্যক্ষের সামনের জায়গাটি ইচ্ছাকৃত ভাবে খুবই ছোট রাখা হয়েছে। এটিকে ‘ওয়েল’ বলে আর এটি সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রতিবাদের এলাকা হিসেবে মানা হয়। তবে এই কারসাজি সফল হবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া তিনি আরও একটি ক্ষেত্রে টক্কর মারার চেষ্টা চালাচ্ছেন আর সেটি হল সংসদের সেই অপরিহার্য যৌথ সভাকক্ষ বা সেন্ট্রাল হল। এখানেই বিভিন্ন দলের সদস্যরা পরস্পরের মধ্যে মুক্ত আলোচনা করেন যার মাধ্যমে কঠিন সমস্যাও মেটানো যায়। আবার নতুন সমঝোতাও তৈরি হয়। মোদির প্রথম পরিকল্পনায় এই কক্ষটি তুলে দেওয়া হয়েছিল। পরের প্রস্তাবে বলা হচ্ছে এটি দু-ভাগ করা হয়েছে। মোদির কোনও ব্যাপারে কিছু বিশ্বাস নেই। আগে তো আমরা প্রবেশ করি, তারপর বুঝতে পারব সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে আর কী কী চাল তিনি খেলতে চলেছেন।
এই নতুন প্রাসাদটি উদ্বোধন করার জন্য যেই দিনটি তিনি বেছে নিয়েছেন সেটি তাঁর গুরু সাভারকারের ১৪০তম জন্মবার্ষিকী। যে সাভারকারকে গান্ধীর হত্যাকারী— ঘৃণ্য নাথুরাম গডসে বারবার তাঁর পরম পূজনীয় গুরু হিসাবে বলে গেছেন। মোদি তবে অনেক দিন একসঙ্গে মহাত্মা গান্ধী আর খুনি গডসেকে নিয়ে খেলার পরে বুঝিয়ে দিলেন তাঁর আসল স্বরূপ কী?