পুরীর রথযাত্রা বাঙালিকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কথা মনে করিয়ে দেয়, যিনি জগন্নাথের প্রতি চরম ভক্তি ও প্রেমের প্রদর্শনের জন্য পরিচিত ছিলেন।১৫১০ সালে সন্ন্যাস গ্রহণ করার পরে শ্রীচৈতন্য যখন পুরীতে পৌঁছেছিলেন, তখন তিনি এতটাই আবেগপ্রবণ হয়েছিলেন যে জগন্নাথের মূর্তিকে আলিঙ্গন করার জন্য দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটেছিলেন।ফলে পুরীর মন্দিরের পুরোহিতরা তাঁকে পাগল ভেবেছিল এবং বিরক্ত হয়ে চূড়ান্ত ভর্ৎসনা করেছিল । এতকিছু সত্ত্বেও শ্রীচৈতন্য আজীবন ওখানেই থেকে গেলেন। পরের ২৪ বছরের মধ্যে প্রথম ৬ বছরে অবশ্য তিনি পুরী থেকেই বৃন্দাবন এবং উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে বিস্তীর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন । মোটামুটি আমরা সকলেই জানি , তিনি ১৫৩৩ সালে পুরীতে রহস্যজনকভাবে মারা যান।
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে শ্রীচৈতন্য জগন্নাথ ধামকে তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, কারণ নিঃসন্দেহে এটি ছিল পূর্ব ভারতে বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান কেন্দ্র এবং মুসলমান শাসিত বাংলার চেয়ে অনেক বেশি পরিচিত। পুরীর রাজা প্রতাপ রুদ্রদেব ছিলেন তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। রথযাত্রার অনুষ্ঠানে চৈতন্যের অংশগ্রহণের অনেক প্রাণবন্ত বর্ণনা আমরা পাই কৃষ্ণদাস কবিরাজের জনপ্রিয় গ্রন্থ চৈতন্য চরিতামৃতের মধ্যলীলায় ।এই গ্রন্থে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে প্রতাপ রুদ্র ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়েছিলেন যাতে মহাপ্রভু এবং তাঁর অনুগামীরা অবাধে রথের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন । গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা জগন্নাথের এক শ্রেণীর পুরোহিত যারা দয়িতাপতি বলে পরিচিত ছিলেন তাদের হাতে ক্রমাগত লাঞ্ছিত হতেন তাই ওদের উন্মত্ত হাতির সাথে তুলনা করেছেন।
কৃষ্ণদাস বর্ণনা করেছেন যে কেমন করে শ্রীচৈতন্য তাঁর অনুগামীদের এক জায়গায় করেছিলেন এবং গাঁদা ফুলের মালা ও চন্দনের তিলক দিয়ে নিজেই তাদের সাজ করেছিলেন। অদ্বৈত আচার্য এবং নিত্যানন্দ প্রভু যখন ভাবে মত্ত ছিলেন, এবং স্বরূপ দামোদর ও শ্রীবাস্তব ঠাকুরের নেতৃত্বে তাঁরা সংকীর্তন করছিলেন, তখন মহাপ্রভু তাঁদের কাছে গিয়েছিলেন এবং তাদের মালা ও তিলক পরিয়েছিলেন। চৈতন্য ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন সংকীর্তনের দল গঠনের তত্ত্বাবধান করতেন এবং নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, হরিদাস এবং বক্রেশ্বর কীভাবে নৃত্যের নেতৃত্ব দেবেন তা ঠিক করেছিলেন।
রথযাত্রা উপলক্ষ্যে দেবতাদের বিশাল মূর্তির কোমরে মোটা রেশমের দড়ির বাঁধন দেওয়া হয়েছিল, যার সাহায্যে এই দয়িতাপতিরা দেবতাদের মন্দির থেকে বাইরে আনত। তারা দেবতাদের মোটা তূলার মাদুরের উপর রাখত যা মন্দির থেকে রথ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকত । এভাবে বাইরে এনে তারপর দেবতাদের রথে বসানো হত । রাজা নিজেই তাঁর সোনার ঝাড়ু দিয়ে জগন্নাথের যাত্রাপথ ঝাঁট দিয়েছিলেন এবং চন্দন কাঠের সুগন্ধি জল ছিটিয়েছিলেন যা দেখে চৈতন্য খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন ।
চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে সুবিশাল রথগুলির বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, "রথগুলি দেখে মনে হত সোনার তৈরি এবং তা সুমেরু পর্বতের মতো উঁচু ছিল" । কৃষ্ণদাসের অপূর্ব ব্যাখ্যার মাধ্যমে যে-কেউই কার্যত পাঁচশো বছর আগে ঘটে যাওয়া রথযাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনাবলির সাক্ষী হতে পারে।অসংখ্য চকচকে পিতলের ঘণ্টা এবং কাঁসর বাজতে থাকে রথ চলতে শুরু করার সাথে সাথে ।রথগুলি নানান রঙের রেশমের কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল এবং তার উপরে উজ্জ্বল আয়না লাগানো ছিল যা সমবেত ভক্তদের চমক লাগিয়ে দিতi। বৈষ্ণব সখীরা এবং কীর্তনীয়ারা সমস্ত পথে ছড়িয়ে থাকা ঝকঝকে সাদা বালি দেখে অবাক হয়েছিল কারন তা দেখতে পবিত্র যমুনার তীরের মতো লাগছিল । এই ব্যবস্থা কাদামাখা , পিচ্ছিল এবং এবড়োখেবড়ো রাস্তাগুলির উপর দিয়ে বিশাল রথগুলিকে টেনে আনা সহজ করেছিল এবং পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনাও দূর করেছিল।
কৃষ্ণদাস বর্ণনা করেছেন যে কেমন করে শ্রীচৈতন্য তাঁর অনুগামীদের এক জায়গায় করেছিলেন এবং গাঁদা ফুলের মালা ও চন্দনের তিলক দিয়ে নিজেই তাদের সাজ করেছিলেন। অদ্বৈত আচার্য এবং নিত্যানন্দ প্রভু যখন ভাবে মত্ত ছিলেন, এবং স্বরূপ দামোদর ও শ্রীবাস্তব ঠাকুরের নেতৃত্বে তাঁরা সংকীর্তন করছিলেন, তখন মহাপ্রভু তাঁদের কাছে গিয়েছিলেন এবং তাদের মালা ও তিলক পরিয়েছিলেন। চৈতন্য ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন সংকীর্তনের দল গঠনের তত্ত্বাবধান করতেন এবং নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, হরিদাস এবং বক্রেশ্বর কীভাবে নৃত্যের নেতৃত্ব দেবেন তা ঠিক করেছিলেন। দলগত সংকীর্তনে কার কি ভূমিকা হবে সে সম্পর্কে চৈতন্য তার অনুগামীদের নির্দেশ দেন। চৈতন্যের মতো একজন মানুষ সর্বদা অন্যজাগতিক হতে যে পারেন না আমরা বুঝতে পারি। তাঁর ব্যবস্থাপনাশৈলী এবং সূক্ষ্ম পরিকল্পনা এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার গভীর আভাস পাই.।
চৈতন্য একদিন দেখলেন যে কুলীনগ্রাম থেকে একটি সংকীর্তন দল এসেছে, তখন তিনি রামানন্দ এবং সত্যরাজাকে নির্দেশ দেন সেই দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য , যাতে কোনও কিছুই বেসুরে না হয় । শ্রীখণ্ডের আরেকটি দলের ক্ষেত্রেও তিনি এই নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করে , নরহরি এবং রঘুনাথকে নেতৃত্ব দিতে বলেন । সংকীর্তনের ছোটো দলগুলি যাতে মিছিলের প্রতিটি দৃশ্যমান স্থানে থাকে তা চৈতন্য নিশ্চিত করেছিলেন যা স্বাভাবিকভাবেই, সমগ্র পুরীবাসীকে বিস্মিত করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে জগন্নাথের রথের সামনের মতো পবিত্র স্থান যেখানে চৈতন্য সংকীর্তনে বিভোর হয়ে কিছু সময় পর পর বাতাসে লাফ দেন, আর তখন অদ্বৈত জপ করতে থাকেন হরি-বোল, হরি-বোল !” চৈতন্য কিছুক্ষণের মধ্যে একবার নীচে পড়ে গেলেন, কিন্তু তিনি মাটিতে গড়াগড়ি দিতে থাকলেও এবং আবারও উঠে একই কাজ করতে থাকেন । চৈতন্যের এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা প্রশংসনীয় ছিল ।
চৈতন্যের অনুগামীদের মধ্যে রামানন্দ, শ্যামানন্দ এবং বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রমুখ ব্রাহ্মণ ছিলেন না অতএব তাঁদের শূদ্র বলেই গণ্য করা হত।। পুরীর শাসক পুরোহিতরা স্পষ্টতই এই শূদ্র নেতৃত্বাধীন উপাসনার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু পুরীর এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই শ্রী চৈতন্য তাঁর কাজ করে গেছেন এবং ধর্মের জগতে শ্রেণিহীন গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন।