কথায় বলে, ভাগ্য মানুষকে গৌরবের পথে নিয়ে যায়, কিন্তু নিয়তি যা দেয় অহঙ্কার তাকে নষ্ট করে। খুব উচ্চ পদে আসীন মানুষদের কাছে মানুষ আশা করে যে তাঁরা কিছু দায়িত্ব স্বীকার করবেন। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি হল, তাঁরা আপন পদটির উপযুক্ত আচরণ করবেন। পদমর্যাদা তাঁরা যদি বাড়াতে না-ও পারেন, পদটির যাতে অবমাননা না হয়, সেটা নিশ্চিত করা তাঁদের কর্তব্য। ভারত এ ব্যাপারে বিশেষ ভাগ্যবান— এক জন ছাড়া সব প্রধানমন্ত্রীই তাঁদের পদের যোগ্য এবং প্রত্যাশিত আচরণই করে গিয়েছেন, এমনকি তাঁদের ব্যক্তিগত মতামতের বিরুদ্ধে গিয়েও। ইদানীং বহুনিন্দিত পণ্ডিত নেহরু নাকি একটুতেই রেগে যেতেন, কিন্তু সামাজিক জীবনে তিনি ছিলেন ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা। সত্যি কথা বলতে কী, তিনিই প্রধানমন্ত্রীসুলভ আচরণের একটা মাপকাঠি তৈরি করে দিয়েছিলেন, সদ্য-প্রয়াত অটলবিহারী বাজপেয়ী যে আচরণরীতিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। এই পরিপ্রেক্ষিতেই, খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তাঁরই দলের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী জনপরিসরে কথা বলার সময় নিজের দায়িত্বের প্রতি নিতান্ত অমনোযোগী।
এর আগে এমন কখনও হয়নি যে, সংসদে কোনও প্রধানমন্ত্রীর কোনও বক্তব্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক বলে সংসদের কার্যবিবরণী থেকে সেই বক্তব্য বাদ দিতে হয়েছে। সংবাদমাধ্যম অবশ্য এই ঘটনাকে ততটা গুরুত্ব দিতে চাইছে না— কিংবা তারা যাতে তত গুরুত্ব না দেয়, সে বিষয়ে তাদের বোঝানো হয়েছে— কিন্তু এই আপাতদৃষ্টিতে ছোট ঘটনাটি ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের মোটের ওপর পরিচ্ছন্ন ইতিহাসে একটি কালো দাগ হিসেবেই থেকে যাবে, যা মুছে ফেলা অসম্ভব। অথচ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই লোকসভায় তাঁর কর্মজীবন শুরুর মুহূর্তে সংসদ ভবনে প্রবেশ করার আগে তার (আশা করা যায়, জীবাণুমুক্ত করে দেওয়া) মেঝেতে অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে চুম্বন করেছিলেন। মুশকিল হল, ক্যামেরাশোভন ভাবভঙ্গি এবং অভ্যেস করা বাগ্মিতাই সব নয়— নেতাদের আচরণ আন্তরিক না হলে সাধারণ মানুষ সেটা ঠিক ধরে ফেলেন। গত ৯ অগস্ট বি কে হরিপ্রসাদ রাজ্যসভায় ডেপুটি স্পিকারের পদের জন্য বিরোধী পক্ষের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ব্যঙ্গ করেন। বি কে হরিপ্রসাদের নাম নিয়ে যে কথার খেলা তিনি সে দিন করেছিলেন, সেটা তাঁর করা একেবারেই উচিত হয়নি। এই ধরনের আচরণ যে একেবারেই নাবালকোচিত, সেই সত্যটা তাঁকে কেউ মনে করিয়ে দিলে ভাল হয়। এবং এই বালকসুলভ চাপল্য নতুন নয়। তাঁর জমানায় যত সরকারি প্রকল্প তৈরি হয়েছে— যার বেশির ভাগই আগের আমলের প্রকল্প নতুন মোড়কে চালানো— তাদের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে এক একটা শব্দ তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী খুব রহস্য করে এই শব্দগুলি ছুড়ে দেন এবং তার পরে সেটির অর্থ ভেঙে বোঝান, গোটা দেশটা যেন একটা কিন্ডারগার্টেন ক্লাস। গোটা দিল্লি জানে, তাঁর ভক্ত পরামর্শদাতারা এবং মোটা মাইনের ট্যাগ-লাইন লিখিয়েরা তাঁর এই ছেলেমানুষি শব্দ-খেলার সঙ্গে তাল রাখতে হিমশিম খেয়ে যান।
অন্য কেউ হলে হয়তো ‘ক্ষমা’ করে দেওয়া যেত, কিন্তু বিরোধীদের অপমানের ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদীর ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ। ২০০২ সালে গুজরাতে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় সেই ভয়াবহ সংখ্যালঘু নিধনের ব্যাপারে এক প্রশ্নের উত্তরে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে তিনি বলেছিলেন, ‘একটা কুকুরছানা গাড়ির চাকার তলায় চলে এলে’ গাড়ির চালক বা সওয়ারকে তো আর দোষ দেওয়া যায় না। এই ভয়ঙ্কর রকমের অসংবেদনশীল মন্তব্য এবং অত্যাচারিত একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে এই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক তুলনা সে দিন তুমুল শোরগোল তুলেছিল। কিন্তু মানুষ অচিরেই সে সব ভুলে প্রাত্যহিকতায় মগ্ন হয়ে পড়েন। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় ঐতিহাসিক প্রচার অভিযানে অবশ্য তিনি অনেক সাবধানী ছিলেন। এর পর ২০১৫ সালে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে নীতীশ কুমার-লালুপ্রসাদ জোটের কাছে ভারতীয় জনতা পার্টি হেরে যায়। নির্বাচনী প্রচারে মোদীর অহেতুক আগ্রাসনে বিজেপির কিছু নেতা তখন বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। দলের সাংসদ ভোলা সিংহ তো খোলাখুলি বলেছিলেন, নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রীর অ-সংসদীয় কথাবার্তা বিহারে বিজেপির হারের অন্যতম কারণ।
যাঁরা মানুষের মর্যাদাহানি করতে ভালবাসেন, তাঁরা সেটা যে কোনও উপলক্ষে এবং যে কোনও ব্যক্তি সম্পর্কেই করে চলেন, সেই উপলক্ষ বা ব্যক্তি যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন। ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিকেও প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে ছাড় দেননি। উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে আনসারির বিদায় উপলক্ষে আয়োজিত আবেগ-আপ্লুত সভাতেও প্রধানমন্ত্রী দেশের জনজীবনে অত্যন্ত সম্মানিত মানুষটিকে আক্রমণ করেন। আক্রমণের কারণ: ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে আনসারি বলেছিলেন, মুসলমানরা এ দেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। (সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমাগত আক্রমণের পরেও কি তাঁর বলা উচিত ছিল যে, মুসলমানরা খুব খুশিই রয়েছে?) হামিদ আনসারিকে ছোট করার জন্য পশ্চিম এশিয়ায় কূটনীতিক হিসেবে তাঁর সুদীর্ঘ এবং সফল কর্মজীবনকে মোদী সে দিন তীব্র ভাবে আক্রমণ করেছিলেন। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আনসারির যোগাযোগ নিয়ে তিনি সে দিন যা বলেছিলেন, তা-ও এই সম্মানিত মানুষটির, এবং তাঁর অতি উচ্চ পদটির প্রতি অসম্মানজনক।
ভোট এলে নরেন্দ্র মোদীর আচরণে বিশেষ অবনতি হয়। গত ডিসেম্বরে গুজরাত নির্বাচনের আগে তিনি নানান কটু মন্তব্য করেছিলেন। ১০ ডিসেম্বর তিনি অত্যন্ত কুরুচিকর ভাবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, আপাদমস্তক ভদ্রলোক মনমোহন সিংহ এবং প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিকে এই বলে আক্রমণ করেন যে, তাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গুজরাত ভোটে জিততে চেষ্টা করেছেন। স্বভাবতই, এই অভিযোগ নিয়ে সংসদ উত্তাল হয়ে ওঠে এবং সংসদের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়, কারণ বিরোধী সাংসদরা প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ দিতে বলেন। শেষ পর্যন্ত, অচলাবস্থা কোনও মতেই কাটছে না দেখে, ব্যাপারটাতে হস্তক্ষেপ করেন অর্থমন্ত্রী, আত্মমর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং স্নিগ্ধ আচরণের জন্য সবাই যাঁকে পছন্দ করেন। তিনি বলেন, ‘‘দেশের প্রতি মনমোহন সিংহ বা হামিদ আনসারির আনুগত্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কখনওই প্রশ্ন তোলেননি বা তুলতে চাননি।’’ অরুণ জেটলি ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, ‘‘এই নেতাদের, এবং দেশের প্রতি তাঁদের আনুগত্যকে আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি।’’ জেটলির ক্ষমাপ্রার্থনায় সংসদ সে দিন শান্ত হয়েছিল বটে, কিন্তু যে প্রধানমন্ত্রী জনসমক্ষে বিদেশি নেতাদের নিয়ম করে জড়িয়ে ধরেন— অনেক নেতাকেই এতে অস্বস্তিতে পড়তে দেখা গিয়েছে— তিনি বিরোধী পক্ষের ক্ষুব্ধ নেতাদের সঙ্গে একটা সাদর করমর্দনও করতে পারলেন না?
কর্নাটকের গত নির্বাচনের সময়েও মোদী আবার ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর যুদ্ধং দেহি মূর্তিতে। গত ৬ মে হুবলিতে একটি জনসভায় তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেস নেতারা ভাল করে শুনে রাখুন, যদি আপনারা সীমা ছাড়িয়ে যান, তা হলে (জানবেন) আমি হলাম মোদী, আপনাদের মাসুল গুনতে হবে।’’ কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির কাছে নালিশ জানায়, আর কী-ই বা করার ছিল তাদের?
সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষা করা যায় সামাজিক জীবনে সু-আচরণের মাধ্যমে, মতামত যা-ই হোক না কেন। পূর্বসূরিরা যে ঐতিহ্য আমাদের দিয়ে গিয়েছেন, সেটা যাঁরা নষ্ট করছেন, তাঁরা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক।