আরবি ভাষায় রামাদান কথাটা যে শব্দটি থেকে এসেছে তার মানে হল পুড়িয়ে-দেওয়া গরম বা প্রচণ্ড শুষ্কতা। অর্থাত্, এর মাধ্যমে কৃচ্ছ্রসাধনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষের প্রত্যয় এবং অন্তরের বিশ্বাস জোরদার হতে পারে।
রমজান মাস এবং ইদের চাঁদ, এইটুকু আমরা জানি, কিন্তু ইদ-উল-ফিতর-এর উত্স সম্বন্ধে অনেকেরই বিশেষ ধারণা নেই। ভারতের বৃহত্তম ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের এই বিরাট উত্সবটি সম্পর্কে আর একটু জানলে মন্দ হয় না। আল্লাহ্-র দূতের মুখে কোরান প্রথম শোনার ঘটনাটির স্মারক হিসেবে চান্দ্র ক্যালেন্ডারের নবম মাসকে হজরত মহম্মদ রমজানের উপবাসের জন্য চিহ্নিত করেছিলেন। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও ইস্টার-এর আগে চল্লিশ দিন উপবাসের রীতি প্রচলিত আছে, যার নাম ‘লেন্ট’, তবে তাঁদের এই উপবাস বাধ্যতামূলক নয়। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরব দুনিয়ার কোথাও কোথাও এ ধরনের উপবাস প্রচলিত ছিল, অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি আবু জানাদ উত্তর ইরাকে তার নজির দেখেছিলেন। কিন্তু প্রাক্-ইসলাম পর্বের কিছু কিছু আচার অনুষ্ঠানকে মহম্মদ নতুন অর্থ দেন, নৈতিকতার প্রেরণায় সমৃদ্ধ করেন। মুসলিমদের জন্য এই উপবাসকে আবশ্যিক কর্তব্যের রূপ দেওয়া তাঁর অবদান। প্রসঙ্গত, ইহুদিরা ‘ইয়ম কিপ্পুর’-এ উপবাস করেন, হিন্দুদের মধ্যে তো উপবাসের নানান রীতি প্রচলিত। তবে সে-সব উপবাস করা না করাও ব্যক্তিগত ইচ্ছার ব্যাপার। ইসলাম ধর্মে রমজানের উপবাস সকলের কর্তব্য, কেবল অসুস্থ বা জরাগ্রস্ত মানুষ, অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং যাঁরা এই সময় স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হন, তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আরবি ভাষায় রামাদান কথাটা যে শব্দটি থেকে এসেছে তার মানে হল পুড়িয়ে-দেওয়া গরম বা প্রচণ্ড শুষ্কতা। অর্থাত্, এর মাধ্যমে কৃচ্ছ্রসাধনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষের প্রত্যয় এবং অন্তরের বিশ্বাস জোরদার হতে পারে। উপবাসের দৈনিক সময়টা সর্বত্র সমান নয়। যেমন আরব দুনিয়ার মতোই ভারতেও সাধারণত পনেরো-ষোলো ঘণ্টা উপবাস করতে হয়, নিউজিল্যান্ডে দশ ঘণ্টারও কম। আবার ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় কুড়ি ঘণ্টা অবধি দিনের আলো থাকে, উত্তর মেরু অঞ্চলে তো সূর্য ডোবেই না, তাই অনেক ক্ষেত্রে মুসলিমরা মক্কার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় অনুসারে উপবাসের মেয়াদ স্থির করেন। পৃথিবীর নানা জায়গায় বেশ কিছু মসজিদে রমজান মাসের তিরিশ রাত্রি ধরে সমগ্র কোরান পাঠ করা হয়, যার নাম তারিভি। এই এক মাস জীবনাচরণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কঠোর সংযম পালনের বিধান দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে এই সময়টিতে সদাচারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, হিংসা ও দ্বেষ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই যখন দেখি, পশ্চিম এশিয়ায় কিছু উন্মাদ এই পবিত্র মাসটিতেও সমধর্মীদের বিরুদ্ধেই বিধ্বংসী ও পৈশাচিক আক্রমণ চালাচ্ছে, সেটা ভয়ঙ্কর রকমের মর্মান্তিক বলে মনে হয়।
দুনিয়ার একশো ষাট কোটি মুসলিম মানুষের অধিকাংশই নিষ্ঠার সঙ্গে ‘সওম’ অর্থাত্ রোজা পালন করেন। ভোর হওয়ার আগে তাঁরা কিছু খেয়ে নেন, যার নাম সুহুর, তার পর ফজ্র-এর নামাজ পড়েন। সূর্যাস্ত অবধি সারা দিন আর কিছু খান না। এবং সম্পূর্ণ উপবাস করেও তাঁরা যেন সমস্ত কর্তব্য যথারীতি পালন করে চলেন, কাজের গতি একটুও যেন না কমে, এটাই ধর্মের বিধান। সূর্যাস্তের পরে সাধারণত খেজুর এবং সুমিষ্ট কোনও পানীয় সহযোগে উপবাস ভঙ্গ করা হয়, তার পর মঘ্রিব-এর চতুর্থ নামাজ পড়া হয়। এর পর একটা সম্পূর্ণ খাবার খাওয়া হয়, যার নাম ইফতার, যে ভোজে সাধারণত অনেকে একসঙ্গে যোগ দেন। রাজনৈতিক নেতারা এখন যে ভাবে ইফতার পার্টিকে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির প্রকরণ বানিয়েছেন, সেটা দেখে খারাপ লাগে।
নৈতিক ও ধর্মীয় চেতনার প্রসার ঘটানো এবং কমিউনিটির বন্ধন সুদৃঢ় করাই এর লক্ষ্য। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটা বড় ব্যাপার হল জাকত। আয়ের একটা অংশ দরিদ্রকে দান করার (‘সাদাকা’) এই রীতি ইসলামি জীবনাচরণের একটি স্তম্ভ।
ইফতারের সূত্রে খাবার রান্নার একটা সমৃদ্ধ ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। দিনের বেলায় যে খাবারের বাজার বন্ধ থাকে, সন্ধের পরে সেখানে রান্না জমে ওঠে, রকমারি সুখাদ্যের পসরা সাজানো হয়, চমত্কার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, আরব দুনিয়ায় নানা রকম রস, স্যালাড এবং অন্য নানা হালকা অ্যাপেটাইজার দিয়ে খাওয়া শুরু হয়, তার পর ভেড়ার মাংস ও অন্য নানা মশলাদার মাংসের পদ, সঙ্গে থাকে চালের পোলাও, ওঁরা বলেন পিলাফ। শেষ পাতে থাকে নরম, মিষ্টি, সুরভিত লকায়মত-এর টুকরো, বাদাম আর মধু দিয়ে তৈরি বাক্লাভা কেক, নুডল আর চিজ সহযোগে বানানো কুনাফে নামক মিষ্টান্ন। এই সব দেখেশুনে অতি সাবধানীরা তিরস্কারের সুরে বলেন, দীর্ঘ উপবাসের ফলে স্বাস্থ্যের যে উপকারটুকু হয়, ইফতারের ভূরিভোজে সেটা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এমনটাই তো মানুষের স্বভাব! তবে এটাও মনে রাখা ভাল যে, ধনীরা শেফদের দিয়ে রাঁধিয়ে ইফতার পার্টি করেন, ভোর হওয়ার আগে সেহ্রির আয়োজনও, আর বাংলার কৃষক চালের গুঁড়ি দিয়ে আন্দোসা বা পাকান বানিয়ে নেন।
একটা কথা এখানে বলা দরকার। যোগ যেমন কেবল শরীরটাকে নানা ভঙ্গিতে বাঁকানো নয়, রোজাও তেমনই কেবল কৃচ্ছ্রসাধনের পরীক্ষা নয়। নৈতিক ও ধর্মীয় চেতনার প্রসার ঘটানো এবং কমিউনিটির বন্ধন সুদৃঢ় করাই এর লক্ষ্য। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটা বড় ব্যাপার হল জাকত। আয়ের একটা অংশ দরিদ্রকে দান করার (‘সাদাকা’) এই রীতি ইসলামি জীবনাচরণের একটি স্তম্ভ। রমজানের সময় এই দানের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়, তার পুণ্যফলও বাড়ে। এবং এতটা কঠোর জীবনযাপন সত্ত্বেও সাধারণ মুসলমানরা এই এক মাস আনন্দের সঙ্গে উদ্যাপন করেন, মসজিদে মসজিদে এবং লোকালয়ের নানা জায়গায় আলো এবং রঙিন লণ্ঠন দিয়ে সাজানো হয়। এই রীতির সূচনা হয়েছিল মিশরে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় মানুষ মশাল এবং প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করেন। জাভায় উপবাস শুরু করার আগে উষ্ণ প্রস্রবণের জলে স্নানের প্রথা আছে, আবার ইন্দোনেশিয়ার কোনও কোনও অঞ্চলে নবীর পক্ষিরাজ ঘোড়ার প্রতি সম্মান জানিয়ে এক ধরনের ড্রাগনের মতো অবয়ব তৈরি করে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সূর্য ওঠার আগে মানুষের ঘুম ভাঙানোর জন্য বিরাট বিরাট ড্রাম বাজানো এবং বাজি ফাটানোরও চল আছে।
অধিকাংশ মুসলমান রমজান মাসের শেষে ইদ-উল-ফিতর-এর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তুরস্ক, রাশিয়া এবং ইউরোপের অনেক দেশে এর নাম বায়রামি। একে অনেকে মিষ্টি উৎসবও বলেন, কোথাও আবার ‘ছোট ইদ’ও বলা হয়, নাইজিরিয়ার ছোট ‘সল্লা’র মতো।
ইদের চাঁদ দেখার পরে রমজানের উপবাস পর্বের অবসান হয়। তখন মুসলমানরা সমবেত প্রার্থনার জন্য একটা বড় জায়গায় সমবেত হন, যে পরিসরটিকে সাধারণত ইদগাহ্ বলা হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের আশীর্বাদ চাওয়ার সময় এটা। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলনেরও সময়, এবং এই দিনটির মহিমা এমনই যে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকেও সবাই কাছে টেনে নেন। শিশুদের কাছে এই সময়টা খুব আনন্দের, কারণ কেবল নতুন জামা নয়, তারা ‘ইদি’ হিসেবে নগদ টাকা পার্বণী পায়, নানান উপহারও মেলে। সম্পন্নরা অভাবী মানুষদের বাড়ির দরজায় অনেক খাবারদাবার রেখে দেন, কেউ আবার টাকাপয়সা ও নানা মূল্যবান সামগ্রীও রাখেন। কমিউনিটি ভোজের আয়োজনও হয়ে থাকে। চকলেট, বাদাম, রকমারি কুকি ও কেক-রুটি, নানান মিষ্টির ব্যবস্থা হয়। আফগানিস্তানে মিষ্টি কেক ও জিলিপি জনপ্রিয়, ইন্দোনেশিয়ায় বাঁশের মধ্যে আঠালো ভাত দিয়ে তৈরি লেমাং-এর দারুণ কদর। তা ছাড়া আছে লাচ্চা, মিষ্টি সেউনিয়া, দুধ, বাদাম, খেজুর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি অপূর্ব সব মিষ্টি। এত মিষ্টির ছড়াছড়ি কেন? দীর্ঘ উপবাসে শরীরের শক্তি ক্ষয় হয়েছে, মিষ্টিতে তার পূরণ হয়। কালজয়ী সমস্ত উত্সবের রীতির পিছনেই যুক্তি থাকে।
সর্বশক্তিমানের কাছে করুণা ভিক্ষা এবং মানবজাতির শান্তি কামনা ইদের প্রার্থনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দুনিয়া জুড়ে মৃত্যু ও ধ্বংসের তাণ্ডব চলছে। এই ইদে আমাদের সকলের আরও অনেক বেশি প্রার্থনা করা উচিত।