সময় হয়েছে নির্বাচনের ফল প্রকাশের। এবং সময় হয়েছে এই সত্য স্বীকার করে নেওয়ার যে, নতুন সরকার যারাই গড়ুক, গত কয়েক বছরে ভারতীয় বাস্তবে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তার প্রভাব কাটবে না। ১৯৪৭ থেকে ২০১৪, এই দীর্ঘ সময়ে ভারতের সামগ্রিক চরিত্র ছিল মোটের উপর সহিষ্ণু, ধর্মনিরপেক্ষ এবং অনেকাংশেই গণতান্ত্রিক আদর্শে আস্থাশীল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে যে সব বিশ্বাস এবং আচরণ এ দেশের সমাজের মনে ঢোকানো হয়েছে এবং লালন করা হয়েছে, তার ফলে কাঁটাটা অনেকখানি ঘুরে গিয়েছে, কেবল হিন্দুত্বের দিকে নয়, দক্ষিণপন্থার দিকেও (দুটো সব সময় এক নয়)। ঘৃণা এখন বৈধতা পেয়েছে, এবং হিন্দুদের একটি বড় অংশ মুসলমান, খ্রিস্টান ও দলিতদের উপর আধিপত্য জাহির করার নীতিকে প্রবল ভাবে সমর্থন করছে। সরকারের রং বদলালেও তারা গুটিয়ে যাবে এবং সহিষ্ণু হয়ে উঠবে, তার কোনও আশা নেই।
মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল দেখিয়েছিলেন, মানুষের ভিতরে একটা সুপ্ত ফ্যাসিবাদী মানসিকতা থাকে, বিভিন্ন সময় কেউ একটা তাকে জাগিয়ে তোলে। আগ্রাসী হিন্দুত্ব আজ দেশের মানুষের একটা বড় অংশের কাছে কেবল সম্মানিতই নয়, কাঙ্ক্ষিত। এক দিকে নিজেকে নিপীড়িত মনে করার ও অন্য দিকে নিজেদের অস্বাভাবিক মূল্যবান ভাবার প্রবণতা, এই দু’টি হল ফ্যাসিবাদী চিন্তার দুই স্তম্ভ। বহু হিন্দুর মজ্জায় মজ্জায় এই মানসিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। গোরক্ষাকে কেন্দ্র করে গণপ্রহার, এমনকি হত্যাকাণ্ডের পরে অল্প কিছু উদার মনোভাবাপন্ন নাগরিক প্রতিবাদ করেছেন বটে, কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হয়নি, এক গা-ছমছমে নীরবতা বহাল থেকেছে। স্পষ্টতই, হিন্দুদের একটা বড় অংশ এই বিষয়ে আপসহীন। সমস্ত মুসলমান গোমাংস খান না, এবং নিজের রুচি ও পছন্দ মাফিক খাওয়ার অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত— এ-সব তথ্য ও যুক্তি তাদের কাছে অর্থহীন। এমনকি কংগ্রেসও তাদের সন্তুষ্ট রাখার তাগিদে এমন অনেক কিছু করেছে যা তাদের ‘নরম হিন্দুত্ব’ অনুশীলনে অভিযুক্ত করেছে।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। এই পরিস্থিতির পিছনে আছে মাংস তথা আমিষ খাওয়ার প্রতি তীব্র ঘৃণা, যা ক্রমশ বাড়ছে। ‘প্রথম রাউন্ড’ শেষ হলে এই ‘বৈষ্ণব নিরামিষ ভক্ষণ’-এর দাপট আরও বাড়বে। বৈষ্ণব, শৈব এবং শাক্ত— হিন্দু বিশ্বাসের তিনটি প্রধান ধারার মধ্যে বহু শতাব্দীর সমন্বয় এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। গাঙ্গেয় অববাহিকায় উচ্চবর্ণের হিন্দু প্রধানত নিরামিষাশী, ফলে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্বের বলয় থেকে বৃহত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারের অভিযানে তারা খাদ্যাভ্যাসকে একটা প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবেই। এর পিছনে কয়েক দশকের উদারপন্থী শাসনের একটা বড় ব্যর্থতার ভূমিকাও অনস্বীকার্য— কয়েক প্রজন্মের অবকাশ পেয়েও উদারপন্থীরা হিন্দি বলয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে উদারতা আনতে পারেননি, এমনকি সেখানকার মানুষকে দ্বিতীয় একটা ভাষাও শেখাতে পারেননি। এই বলয়ের বাইরে ভারতের প্রায় সমস্ত অঞ্চলে বহু মানুষ দু’টি বা তিনটি ভাষা (ও সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি) শেখার চেষ্টা করে আসছেন, অথচ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা তাঁদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি নিয়েই পরিতৃপ্ত, এবং তাঁদের প্রতিনিধিরা অবিচল নির্লজ্জতায় দেশের সর্বত্র কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত অফিসে ও প্রতিষ্ঠানে ‘সরকারি ভাষা’র সাম্রাজ্য কায়েম করতে ব্যস্ত। মনে রাখতে হবে, উদারপন্থীদের প্রতি হিন্দিওয়ালাদের (এবং, বস্তুত, হিন্দি বলয়ের বাইরেও ইংরেজি-না-জানা অনেকেরই) বিদ্বেষের একটা বড় কারণ হল, তাঁরা ইংরেজি জানেন, অনেকে বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। এখন এই বিদ্বেষ ‘দেশি’ গর্বের কাছে একটা বৈধতা পেয়ে গিয়েছে, তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে কিছু বানানো ইতিহাস। নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, এই মানসিকতা সহজে নেহরুবাদী উদারতার ধারাকে তার পুরনো পরিসর ছেড়ে দেবে, তার আশা নেই।
আর একটা ব্যাপার এখানে প্রাসঙ্গিক। চিরকাল ভারতের গর্ব ছিল, তৃতীয় বিশ্বে একমাত্র এই দেশেই সেনাবাহিনীকে তাদের ছাউনিতে এবং ক্যান্টনমেন্টে সুস্থিত রাখা গিয়েছে। কিন্তু এই গর্ব আর কত দিন থাকবে, বলা কঠিন। প্রায় এক ডজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্তা নাকি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন বা বর্তমান সদস্য ও তাঁদের পরিজনবর্গের একটা অংশ দৃশ্যত মনে করেন, কেবল বিজেপিই তাঁদের কথা ভাবে। আসলে, সমস্ত দেশের মতোই এ দেশের দক্ষিণপন্থীদেরও যথার্থ কোনও রাজনৈতিক আদর্শ নেই, ফলে তারা অতি-জাতীয়তার উদগ্র আবেগকে পুঁজি করেছে। এখন তা রাষ্ট্রীয় নীতি এবং প্রচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত, তাতে বিপুল মদত দিচ্ছে ব্যাধিগ্রস্ত সমাজমাধ্যম।
অন্য দিকে, এই রাজনৈতিক শিবিরের লোকেরা চিরকাল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে, তার তীব্রতম মুহূর্তেও, নিজেদের সরিয়ে রেখেছিলেন, তাঁদের ভাণ্ডারে সে আন্দোলনের এক জন নেতাকেও পাওয়া যাবে না, সেই কারণেই তাঁরা কংগ্রেসের ইতিহাস থেকে তেমন নেতার দখল নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আবার, এঁদের দাবি, লৌহকঠিন হাতে সন্ত্রাস দমন করেছেন, অথচ সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৮’র মধ্যে ভারতে ৩৮৮টি বড় আকারের সন্ত্রাসী হানা ঘটেছে। কাশ্মীর কার্যত হাতের বাইরে চলে গিয়েছে— বহু চেষ্টায় যে ‘ভিয়েতনাম’ তৈরি করা হয়েছে, যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদের সেই সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। অতি-জাতীয়তাবাদ এ দেশে কায়েম হয়েছে।
উদারপন্থীরা বহু দিন একটানা দেশ শাসন করেছেন, কিন্তু সরকার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি হিন্দুদের ইতিহাসের কিছু সত্য কখনও সাহস করে বলতে পারেনি। যেমন, বলতে পারেনি, প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ ও জৈনরা কী ভাবে নিপীড়িত হয়েছিল। সমস্ত বৌদ্ধ বিহার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মুসলমানরা ধ্বংস করেনি, বস্তুত ‘ধ্বংসস্তূপ’ শব্দটাই (ক্ষয় নয়, ধ্বংস) ইতিহাসের অনেকখানি সত্য উন্মোচন করে দেয়। কিংবা, একটা কথা ভাবা যাক। হিন্দুরা ধর্মপ্রচার ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটা বড় অঞ্চল হিন্দু হয়ে গেল কী করে? ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের নিরন্তর অভিযান কি তার মূল চরিত্রে খ্রিস্টধর্ম বা ইসলামের প্রচার অভিযানের সঙ্গে অনেকটাই এক রকম নয়? হিন্দুদের ইতিহাসের সমস্ত সত্য সামনে রাখলে তাঁরা অনেকেই মুসলিম শাসনে হিন্দু-নিপীড়নের প্রচলিত ধারণা নিয়ে দু’বার ভাবতেন বলেই মনে হয়। এবং সে ক্ষেত্রে, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের এই দুর্নিবার দানব হয়তো জন্মই নিত না।
এটা মানতেই হবে যে, ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান সন্ত্রাসীরা কোথাও আক্রমণ করলে উদারপন্থীদের আশ্চর্য নীরবতা তাঁদের প্রতি তাঁদের বিরোধীদের বিতৃষ্ণা তীব্রতর করে তোলে, বিরোধীর সংখ্যাও বাড়িয়ে দেয়। ভিক্টর উলরিখ তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত হিটলার: অ্যাসেন্ট নামক জীবনীগ্রন্থে দেখিয়েছেন, সেই একনায়কের কদর্য বক্তৃতা এবং মতামতগুলি রীতিমতো পরিকল্পনা করেই তৈরি করা হত, যাতে সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়া যায়, জাগিয়ে তোলা যায় জনতার বিপুল প্রতিক্রিয়া। বস্তুত, উইলিয়ম রাইখ-এর দ্য মাস সাইকোলজি অব ফ্যাসিজ়্ম (১৯৩৩) গ্রন্থটি আজও সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক। নানা দেশকে এই রাজনীতি বেছে নেওয়ার খুব চড়া দাম মেটাতে হয়েছে, এক ভয়াবহ বিধ্বংসী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। একটা নির্বাচনের ফলাফল সেই পরিণাম থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে, এমন ভরসা নেই। ভাইরাস এখন মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে।