ভারতের শেয়ার বাজারে গত ৪ জুন যে পতন হয়েছে, তেমন ঐতিহাসিক পতন বিগত চার বছরে হয়নি। একদিনে শেয়ার বাজার এতটা পড়েনি। শেয়ার বাজারের সূচক হল সেনসেক্স ও নিফটি। যে মুহূর্তে খবরে প্রকাশ পেল যে অষ্টাদশ লোকসভায় ভারতীয় জনতা পার্টি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার দিকে এগোচ্ছে, সেদিন সেই মূহূর্ত থেকে সেনসেক্স ও নিফটিতে প্রায় ৫ শতাংশ পতন শুরু হল।
শেয়ার বাজারের সঙ্গে নির্বাচনী ফলাফলের সংযোগের এই যে খেলাটা সেটা একটা ইচ্ছাকৃত পরিকল্পনার অঙ্গ বিশেষ আর তার ফলে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ২০-৩০ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই খেলাটার সুলুকসন্ধান বুঝতে গেলে প্রথমে আমাদের দেখতে হবে কীভাবে কয়েকজন শেয়ার ব্যবসায়ী ও সংস্থা কৃত্রিমভাবে কিছু শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে, যে দামবৃদ্ধি ওই শেয়ারগুলোর আসল দামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হলে সেটা দেখার দায়িত্ব স্টক এক্সচেঞ্জের ওপর ন্যস্ত। সেবির ভূমিকা সেক্ষেত্রে একজন কড়া রেফারির আর তার উচিত যেসব খেলোয়াড় ফাউল করছে তাদের হলুদ এবং লাল কার্ড দেখানো।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিগত ৮ বছরে সেবি সেইসব সময়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখার অভ্যাস রপ্ত করে নিয়েছে যেসব সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সংস্থাগুলো ‘সার্কুলার ট্রেডিং’ বা অন্য কোনও সন্দেহজনক ক্রিয়াকলাপে জড়িয়ে পড়ে। সত্যি কথা বলতে কী, ২০১৭ ও ২০১৮-তে সেবি নিজেদের চালু করা বিদেশি বিনিয়োগের উৎস ও মালিকানা-সংক্রান্ত কঠোর বিধিসমূহ সংশোধন করে। তার ফলে, যে-সকল বৃহৎ বিদেশি বিনিয়োগ আদানির সংস্থাগুলিতে হয়েছিল সেগুলো নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার সম্ভাবনা লুপ্ত হয়। হিন্ডেনবার্গ একটি বিদেশি আর্থিক সংস্থা। এই সংস্থাটি খোলাখুলি অভিযোগ করেছিল যে, আদানির সংস্থাসমূহ বিদেশ থেকে ভারতীয় কালো টাকা ঘুরিয়ে এনে এভাবে ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। ২০২৩-এর মে মাসে মুম্বইয়ের সুপরিচিত শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞ দেবাশিস বসু লিখেছিলেন যে, সেবির নাকের ডগায় আদানির শেয়ারগুলো নিয়ে পাগলের মতো তামাশা চলছে। ফলে, এ বছরে আদানি গ্রিনের দাম ৫০০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আদানির টোটাল গ্যাসের দাম বেড়েছে ৩৮০০ শতাংশ। আদানি এন্টারপ্রাইজেস-এর শেয়ারের দাম বেড়েছে ২২০০ শতাংশ। শেষোক্ত দুটি শেয়ারের দাম বেড়েছে আড়াই বছরে।
যেই ভোটপর্ব মিটল, সঙ্গে সঙ্গে একদল ভোট-বিশেষজ্ঞ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এক্সিট পোল নিয়ে একটা পূর্বপরিকল্পিত ভুয়ো খবর বাজারকে গেলাতে। বলা হল সাত দফার ভোটে বিপুলভাবে জয় পেতে চলেছেন মোদি। প্রত্যেকে সংশয় সন্দেহ সত্ত্বেও ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। মুখ্যত এই কারণে যে, ওই ভোট-বিশেষজ্ঞরা সুপরিচিত এবং প্রতিটি বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল কম-বেশি একইরকম। গোদি মিডিয়া জানিয়ে দিল বিপুল ভোটে তৃতীয়বারের জন্য মোদির প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত।
এ বছর ২৩ মে-র ঘটনা। নির্বাচন তখন পুরোদমে চলছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইকোনমিক টাইমসকে বললেন, শেয়ার বাজার এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছাতে চলেছে কারণ বিজেপি এবার রেকর্ড সংখ্যক আসন পাবে। তাঁর কথায় কয়েক লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ হল শেয়ার বাজারে। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর বললেন এমন কিছু কথা যা শেয়ার বাজারকে এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছে দিল।
আসল খেলাটা হল শনিবার দিন অর্থাৎ ১ জুন। যেই ভোটপর্ব মিটল, সঙ্গে সঙ্গে একদল ভোট-বিশেষজ্ঞ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এক্সিট পোল নিয়ে একটা পূর্বপরিকল্পিত ভুয়ো খবর বাজারকে গেলাতে। বলা হল সাত দফার ভোটে বিপুলভাবে জয় পেতে চলেছেন মোদি। প্রত্যেকে সংশয় সন্দেহ সত্ত্বেও ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। মুখ্যত এই কারণে যে, ওই ভোট-বিশেষজ্ঞরা সুপরিচিত এবং প্রতিটি বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল কম-বেশি একইরকম। গোদি মিডিয়া জানিয়ে দিল বিপুল ভোটে তৃতীয়বারের জন্য মোদির প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত। ২ জুন দেশের ব্যবসায়ী মহল উৎসবে মেতে উঠল এবং সোমবার শেয়ার বাজার খোলার জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। টিভি এবং সংবাদপত্র জগতে মোদির চোখরাঙানিতে ভীত সন্ত্রস্তরা মোদির অপ্রতিহত জয়ের সম্ভাবনায় আরও ত্রস্ত শঙ্কিত হয়ে উঠল। একই সঙ্গে যে-সকল ভারতীয় মনে মনে জানতেন বিরোধীরা এবার ভাল ফল করতে চলেছেন তাঁরাও হতাশ হয়ে পড়লেন। চারদিকে মোদি-মোদি চিৎকার। তার মধ্যেই আমাদের মতো কেউ কেউ ২ জুন একজিট পোলের সারবত্তা নিয়ে মত প্রকাশ করলাম। গোদি মিডিয়ার যে অংশ ভোট-পণ্ডিতের ভূমিকা পালন করছিল তারাও মোদি হারলে দেশে অস্থিরতা তৈরির জন্য জমি প্রস্তুত করছিল তখন। শেয়ার বাজার নিয়ে ওরা যে একটা ভয়ানক খেলা খেলছে, সে-বিষয়ে আমরা সকলকে অবহিত করা শুরু করলাম। অনেকে আমাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন, কিন্তু চারিদিকে মোদির জয়ধ্বনির মধ্য তাদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। নইলে দৈনিক ভাস্কর, মালায়লাম, এডিনা অ্যান্ড রুদ্রের মতো সংস্থার বুথফেরত সমীক্ষার ফালাফল বিভিন্ন রাজ্যে এনডিএ-র হারের ইঙ্গিত দিয়েছিল। প্রত্যাশামতোই ৩ জুন সেনসেক্স ও নিফটি পরের দিন ইভিএম খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই ৩ শতাংশ বেড়ে গেল। বিগত ৩ বছরে একদিনে শেয়ার বাজারে এরকম ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়নি। বাজার যখন বন্ধ হল তখন বিনিয়োগকারীদের লাভের অঙ্ক ১৩.৭৮ লক্ষ কোটি ছুঁয়েছে। সেনসেক্স বেড়েছে ৩.৭৫ শতাংশ। ইন্ট্রা-ডে-তে বৃদ্ধি সর্বকালীন রেকর্ড— ৭৬.৭৩৯। মোদি পুঁজিবাদীদের আনুকূল্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সৌজন্যে বিপুল বৃদ্ধির তুফান চারিদিকে। এর মধ্যে সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশের মধ্যে ছোট রাজ্যে বিজেপির সাফল্যে উল্লাস আরও বাড়ল। কিন্তু ৪ জুন যখন ভোটগণনা শুরু হল, ফলাফলের প্রবণতা স্পষ্টতর হতে লাগল, তখন বড় বড় মোদি-সমর্থকও মুখ কালো করে বলতে শুরু করলেন, বিজেপি হয়তো নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পাবে না। এমনই বিষণ্ণতার ছায়াপাত শেয়ার বাজারে, তবু মোদি-ভক্তদের বৃথা আশা ‘মরিয়াও মরে না’। কিন্তু বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা হাওয়া বুঝে শেয়ার বেচা শুরু করলেন। ফলে বাজারে অভাবনীয় পতন। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে ৫৪০০ কোম্পানির মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ৩ জুন ছিল ৪৪৪৬ লক্ষ কোটি। আর ৪ জুন সেটা নেমে এল ৩৯.৫ লক্ষ কোটি টাকায়! গড়পড়তা রাজ্যগুলোর বার্ষিক বাজেট-বরাদ্দের প্রায় দ্বিগুণ অঙ্ক খোয়া গেল একদিনে, অবিশ্বাস্যভাবে। অর্থ তো উধাও হয়ে যায় না কখনও। কেবল পকেট থেকে তা চলে যায় অন্যজনের পকেটে। এবার জানতে হবে বাজারের এত লক্ষ কোটি টাকা শেষমেশ কার পকেটে গেল।