ইতিহাস আমাদের স্পষ্ট জানায় (জানাচ্ছে) যে, গাঁধীকে সারা জীবন ধরে ভারতীয় জনতা দলের সৃষ্টিকারী সংস্থা ও আদর্শগত পরিচালক, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস, অক্লান্ত বিরোধিতা করে গেছে। এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁকে অতি তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানিয়ে এসেছে।
সরকারি মতে আজ মহাত্মা গাঁধীর জন্মের সার্ধশতবর্ষের উদ্যাপনের সমাপ্তি। এই কোভিড সংক্রমণের মাঝেও বেশ ঘটা করে উৎসব অনুষ্ঠান নিশ্চই হবে, অন্তত টিভির পর্দার জন্য। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে যে সব কার্যক্রম ভারত সরকার গত দু’বছর ধরে কার্যকরী করলেন, সেইগুলি কতটুকু সফল হয়েছে আর সাধারণ মানুষকে গান্ধীর ভাবধারার প্রতি আকর্ষিত করেছে, তা বিচার করে কোনো লাভ নেই, শোনার লোকের অভাবে। মূর্তি স্থাপনেরও খুব একটা সুযোগ নেই, কেননা বিগত ৭২ বছরে এমন কোনো শহর বা গঞ্জ বাকি নেই, যেখানে গান্ধীকে নিয়ে ভাস্কর্যের নিদর্শন দেখা যায় না। রাস্তার নামকরণ আমাদের একটা জাতীয় বদ্ধসংস্কার, কিন্তু এ ব্যাপারেও খুব একটা অবকাশ নেই — আমরা তো কত যুগ আগেই বিভিন্ন রাজ্যে প্রধান সড়কের নাম এম জি রোড করে ফেলেছি।
তবে এই শাসক দল যে গান্ধীকে আদৌও স্মরণ করেছে, সেটাই অনেকের কাছে আশ্চর্যের ব্যাপার। ইতিহাস আমাদের স্পষ্ট জানায় (জানাচ্ছে) যে, গাঁধীকে সারা জীবন ধরে ভারতীয় জনতা দলের সৃষ্টিকারী সংস্থা ও আদর্শগত পরিচালক, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস, অক্লান্ত বিরোধিতা করে গেছে। এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁকে অতি তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানিয়ে এসেছে। অতএব কয়েক বছর আগেও ভাবা যায়নি যে, এই দল যে শেষ পর্যন্ত তাঁকে কিছু কিছুটা হলেও স্বীকার করবে আর সম্মান দেবে, তা আন্তরিক হোক বা না হোক।
এই সংকেত বোঝার জন্য আমাদের একটু দেখার দরকার সেই সময় কারা মহাত্মার প্রতি পরাঙ্মুখ হয়েছিলেন। এমন নয় যে শুধু আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার বা তাঁর পরের কর্ণধার গোলওয়ালকর এবং তাঁদের সাথীরা অকপট ভাষায় গাঁধীর নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব বা দলিত নেতা ভীমরাও রামজি আম্বেদকরও তাঁর সাথে সরাসরি সংঘাতে এসেছিলেন। গাঁধীর উপরে রাগ বা অভিমান করে অথবা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভিন্নমত প্রকাশ করে কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতাই তাঁকে ছেড়ে নিজেদের পথে চলে গিয়েছিলেন। আবার অনেকেই ফিরে এসেছিলেন তাঁর নেতৃত্বে কাজ করার জন্য। তখন কংগ্রেস বলতে একটি জাতীয় আন্দোলনের নাম বোঝাত — কোনো সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক দল নয়। আর গাঁধী তো এখনকার মহান নেতাদের মতন অসহমান ছিলেন না। রাজনীতিতে তিনি যথেষ্ট বিচক্ষণ ছিলেন, কিন্তু সবাই এটাও জানতেন যে তাঁকে তাঁর আদর্শ থেকে এক পাও অপসরণ করা করানো যাবে না। এ ব্যাপারে তিনি একেবারেই অনড়। কিন্তু গান্ধীর নীতি না মানাকে কোনো মহাপাপ হিসাবে ধরা হত না। যিনিই বিরোধ করছেন, তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র বিরোধী বলে তিরস্কার করাও হত না। কিন্তু আমরা যদি সুভাষ বসুর বিদ্রোহকে কখনোই রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে মানতে না পারি বা অন্য যাঁরা কংগ্রেস ছেড়েছিলেন, তাঁদেরকে এক বৃহৎ পরিবারের সদস্য বলে গ্রহণ করতে পারি আর তাঁদেরকে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে এসেছি, তবে তাহলে আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, আম্বেদকর বা কমিউনিস্ট পার্টিকে অন্য চোখে দেখি কেন?
প্রশ্নটা খুবই জটিল আর ব্যাখ্যাও ততই দুরূহ। তথ্যগুলি এক এক করে দেখাই যাক না। কংগ্রেস সভাপতির পদের নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র সরাসরি গাঁধীপন্থীদের হারিয়ে দেওয়ার পরেও তাঁকে ওই আসন ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এটা নিছক একটা রাজনৈতিক ধূর্ততার পরিচয়। কিন্তু এই ঘটনা যদি নাও হত, তাহলেও আমরা বুঝতে পারছি যে অধৈর্য কার্যদক্ষ যুধ্যমান সুভাষ গাঁধীজির ওই অতি ধৈর্যশীল অহিংসার পথ আর মানতে নারাজ। সুভাষের পদত্যাগ এবং দল ছাড়ার অধ্যায় নিয়ে এত গবেষণা হয়েছে যে, এই নিয়ে আবার নতুন করে ভিমরুলের চাকে ঢিল মারা বোধহয় উচিত নয়। ১৯৪২-এ গাঁধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের খবর পেয়েই বার্লিনে সুভাষ তাঁর সাথী সি এন নাম্বিয়ারকে বললেন যে তাঁর ভীষণ ইচ্ছে করছে এই সময় তাঁর প্রিয় বাপুজীর পাশে থাকতে। আজাদ হিন্দ ফৌজের বেতারে তিনি গাঁধীজিকে তাঁর প্রণাম জানিয়েছেন আর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছেন। ১৯৪৪-এ কস্তুরবার মৃত্যুতে সুভাষ গভীর শোকাহত হয়েছিলেন আর বর্মা থেকে তখন ঘোষণা করেছিলেন যে ভারতীয় জাতি তাঁদের মাকে হারালেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের দু’টি অংশকে তিনি নাম দিয়েছিলেন গাঁধী ব্রিগেড ও নেহরু ব্রিগেড। তাঁর দুর্ঘটনার কথা শুনে পণ্ডিত নেহরু প্রকাশ্যে কেঁদে উঠেছিলেন এবং তাঁর কন্যা যাতে মাসে মাসে কিছু অর্থসাহায্য পায়ে, তার জন্যে তিনি একটি ট্রাস্টও গঠন করেছিলেন। গত বছর সবরমতি আশ্রমের একটি সভায় সুগত বসু বার বার বলেছিলেন যে গাঁধী সুভাষ ও নেহরুর সম্পর্ক নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে এবং কয়েকটি মতভেদের ঘটনাকে অতিরঞ্জিত ভাবে পেশ করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের ব্যাপারে আমাদের শুধু একটিই নিবেদন আর সেটা হল এই যে সুভাষচন্দ্র গাঁধীর রাজনৈতিক বিরোধ করা সত্ত্বেও এক দিনের জন্যও তাঁকে অশ্রদ্ধা করেননি এবং কোনো বিষাক্ত ঘৃণা প্রদর্শন করেননি। গাঁধীও তাঁর প্রতি স্নেহ কোনো অংশে কম করেননি।
নেতাজির পরেও যাঁরা কংগ্রেস পরিত্যাগ করেছিলেন, যেমন জয়প্রকাশ নারায়ণ বা রাম মনোহর লোহিয়া, তাঁরাও কিন্তু গাঁধী বা নেহরুকে নীতিগতভাবে তীব্র বিরোধ জানালেও, এক দিনের জন্যেও সৌজন্য বা সম্মান কমাননি।
এবার আসা যাক ভীমরাও আম্বেদকরের কথায়। তিনি নিউ ইয়র্ক এবং লন্ডন থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশে ফিরে দেখেন যে ভয়ঙ্কর জাতিবাদ যেমন ছিল তাই রইল। তাঁর উপর নিম্ন জাতির পাংশু একেবারে মেটেনি। পাশ্চাত্য দুনিয়ার সবচেয়ে নামী শিক্ষা সংস্থাগুলি থেকে বার বার ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে সম্মানিত করার পরেও ভারতের উচ্চবর্ণীয় শ্রেণির কাছে তিনি সেই অচ্ছুতই থেকে গেলেন। অতএব তাঁর জীবনের প্রধান নিশান তিনি বানালেন জাতিভিত্তিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অত্যাচার আর অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াইকে। তিনি মনে করতেন এবং ভাবতেন যে হিন্দুসভ্যতা হচ্ছে মানবতাকে দমন করার। এই ধৰ্ম বলে এক বৃহৎ শ্রেণির মানুষের শুধু ছোঁয়াই বাকিদের দূষিত করে। গান্ধী এই হরিজন সমাজের জন্য অক্লান্ত চেষ্টা করেছেন কিন্তু জাতিবাদকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে নারাজ ছিলেন। আম্বেদকর এই অবস্থান কিছুতেই মানতে পারলেন না। তাঁর অভিমত গাঁধী ওই শোষিত মানুষদের হরিজন বলে আরো বেশি ক্ষতি করছেন। ১৯১৯ সনে যখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৮, তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে প্রথম দাবি রাখলেন অস্পৃশ্য জাতিদের জন্যে যেন পৃথক একটি নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি করা হয়। তার কয়েক বছর পরেই তিনি দলিতদের স্বার্থে প্রতিবাদ শুরু করলেন এবং এক আলাদা পথ বেছে নিলেন। গাঁধীর থেকে দূরে চলে গেলেন।
১৯৩২-এ তাঁর ব্যক্তিগত খ্যাতি এবং অন্ত্যজ সমাজের প্রতিনিধি হওয়ার সুবাদে ব্রিটিশ সরকার আম্বেদকরকে অমান্ত্রিত করল লন্ডনে দ্বিতীয় রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে। মহাত্মা গান্ধীকে তো অবশ্যই ডেকেছিল। সেখানে সকলে মেনে নিল মুসলমানদের ও শিখদের জন্যে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর কথা। কিন্তু আম্বেদকর যখন অস্পৃশ্য সম্প্রদায়কেও ওই এক ভিন্ন ভোট দেওয়ার অধিকার দাবি করলেন, গান্ধী প্রচণ্ডভাবে বিরোধ করলেন। তাঁর মতে এতে হিন্দু সমাজকে ভবিষ্যতে বিভক্ত হতে হবে কিন্তু আম্বেদকরের বক্তব্য ছিল যে শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণির ক্ষমতাই কমতে পারে। ব্রিটিশরা এই সুযোগে তাদের চাল খেলে ১৯৩২ সালেই বিবৃতি দিল যে তারা আম্বেদকরের সাথে একমত এবং পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী করা হবে। সেই শুনেই মহাত্মা গাঁধী পুনের এরোদা-য় য়েরওয়াদা কেন্দ্রীয় কারাগারে (Yerwada Central Jail) রাজনৈতিক উপবাস শুরু করলেন। সেই সময় উচ্চ বর্ণের তুলনায় দলিত সমাজের মধ্যে সচেতনতা কম ছিল, অতএব গাঁধী জনমত নিজের দিকে টানতে পারলেন। যত দিন যায় শরীর ও স্বাস্থ্য দুইয়ের অবনতি দেখে সকলেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং আম্বেদকরকে সব দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে হল। শেষে ২৪ সেপ্টেম্বর গাঁধীর সাথে ঐতিহাসিক পুনা বা পুনে চুক্তি সই করলেন। তাতে দু’পক্ষই মেনে নিল যে নির্বাচনের তালিকা একই থাকলেও বেশ কয়েকটি আসন অন্ত্যজ শ্রেণীর জন্যে সুরক্ষিত থাকবে। এ ছাড়াও দলিতরা আরও কয়েকটি সুবিধা পেতে সফল হলেন। যাই হোক না কেন, দুই নেতার মধ্যে আদর্শ ও রাজনীতির লড়াই কখনও কোনো ব্যক্তিগত ঘৃণা, কুৎসা বা ঝগড়ার স্তরে নামেনি। দুই উচ্চশিক্ষিত ভদ্র পরিবারের সন্তানদের কাছ থেকে যা আশা করে সকলে।
এর পর দেখা যাক হিন্দু মহাসভার বিরোধিতা। ইতিহাসের তথ্য থেকে দেখা যায় যে, মহাসভার বিরোধিতা সৌজন্যতার মাত্রার নীচে নেমে যায়। হিন্দুদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে দেখা গেলেও ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ স্থাপনের পরে তা একটা অন্য রূপ ধারণ করল। প্রথম কয়েক বছর বিভিন্ন আকার নেওয়ার পরে ১৯১৫-তে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যর নেতৃত্বে একটি সংগঠন হিসেবে স্থাপিত হল। তার অনেক পরে ১৯৩৩-এ রাজনৈতিক ডালে পরিণত হয়। মালব্য গোঁড়া হিন্দু ছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে দেশপ্রেমী ও জাতীয়তাবাদীও। মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসে যোগদানের প্রায় দু-দশক আগে থেকে তিনি ওই ধারার সাথে যুক্ত ছিলেন যথেষ্ট সক্রিয় ভাবে। তিনি চার বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিও হয়েছিলেন। ইতিহাস বলে যে ১৯২৪ নাগাদ সাভারকর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই এই সংগঠন উগ্র হিন্দুত্ববাদী হতে লাগল। তার পরের বছর কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার হিন্দু মহাসভা ছেড়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ গঠন করলেন, যদিও তিনি দামোদর সাভারকরের হিন্দুত্বের আদর্শে বিশ্বাস করতেন। রাজনীতিতে সোজাসুজি ভাবে ঢুকতে হেডগেওয়ার নারাজ ছিলেন। হেডগেওয়ারের জীবনীকার এইচ ভি শেষাদ্রি প্রচুর প্রমাণ দিয়েছেন যে, সঙ্ঘ গাঁধীর ধর্মনিরপেক্ষবাদে কতটা ক্ষুব্ধ ছিল।
১৯২৭-এ গান্ধী রত্নগিরিতে গিয়ে সাভারকরের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। এটা তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ নয়। এর আগে ১৯০৯ সালে লন্ডনে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল এবং একটি সভায় তাঁরা একে অপরকে মহান বলে উচ্চ প্রসংশা করেছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে প্রচুর বিষয়ে দ্বিমত দেখা দিল — আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হবে নাকি সশস্ত্র থেকে আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা পরিত্যাগ করা নাকি গ্রহণ করা, এ রকম নানা বিষয়ে। দূরত্ব বাড়তেই থাকল আর সাভারকর ব্যক্তিগত ভাবে গাঁধীর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন। এই সময় আম্বেদকরও গিয়ে সাভারকরের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন এবং সাভারকর প্রকাশ্যে অন্ত্যজ জাতিদের পক্ষে লড়াইও করেছিলেন। অনেকেই জানেন যে সাভারকর ব্রিটিশ রাজশক্তির কাছে মাথা নত করে অনেক বার ক্ষমা চেয়ে মুক্তি ভিক্ষা করেছিলেন। তাঁকে কারামুক্ত করার দাবিতে যাঁরা ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, গাঁধী তাঁদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন। রাজনীতিতে মতবিরোধ খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু তাকে সাভারকর যে ভাবে গাঁধী ও কংগ্রেসের প্রতি অনিয়ন্ত্রিত ঘৃণা ও বিদ্বেষে পরিণত করতেন, তা ছিল অতি ভয়ঙ্কর। গান্ধীর প্রতি হিন্দু মহাসভার তিক্ততা ক্রমশ বেড়েই চলল এবং এই দলের সদস্য, সাভারকরের আর এক অন্ধ ভক্ত নাথুরাম গডসেই শেষ পর্যন্ত মহাত্মাকে হত্যা করলেন।
সাক্ষ্য তথ্য স্পষ্ট দেখায় যে, আরএসএস আর হিন্দু মহাসভা শুধু গাঁধী বিরোধী ছিল না, তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে সব সময় দূরত্ব বজায় রেখেছে। এমনকি ১৯৪২-এ গাঁধীজির ডাকা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, যাকে দেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে সঙ্কটময় মুহূর্ত বলা হয়, সেই সময়ও এই দুই সংস্থা ব্রিটিশ সরকারেরই পাশে ছিল, গাঁধীর দিকে নয়। মহাসভার সাভারকর ইংরেজদের সরাসরি সাহায্য না করলেও পরোক্ষ ভাবে মদত জুগিয়েছেন। কিন্তু তাঁরই দলের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আগস্ট বিপ্লবকে ব্যর্থ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তিনি তখন ফজলুল হক মন্ত্রিসভার বরিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। ’৪২-এর জুলাই মাসে তিনি লিখিত ভাবে সাম্রাজ্যবাদ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানান এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার জন্যে সওয়াল করেন। পরবর্তীকালে তিনি আজকের ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্বসূরি ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পূজিত। বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু যখন শাসকেরা তাঁকে কোনো গুরুত্বই দিলেন না, তিনি তখন অন্য সুরে লিখলেন। কয়েক মাস পরে ওই মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করলেন আর সেই সময় ব্রিটিশ রাজের অনেক গালমন্দ করলেন। যেই হিন্দু মহাসভা গাঁধীকে দেশ বিভাজনের জন্যে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে হত্যা করল, সেই দলের নেতা শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু এই মহাদেশের পূর্ব অঞ্চলে বঙ্গভঙ্গের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের গাঁধী বিদ্বেষ আরও ধারালো ছিল আর সাংগঠনিক শক্তি অনেক বেশি ভয়াবহ। এই সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার কিন্তু এক সময় গাঁধীকে অনুসরণ করতেন এবং তার জন্যে শাস্তিও পেয়েছিলেন। তিনি অবশ্য গাঁধীর মুসলমান প্রীতি একেবারেই মানতে নারাজ, তাই সাভারকরের কাছে চলে গেলেন। আগেই বলা হয়েছে যে, তাঁর সঙ্ঘ জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনো ভূমিকা নেয়নি। এবং গাঁধীর পথকে সর্বনাশী ভুল পথ বলে বহু সমালোচনা করেছিল। এখন অবশ্য আরএসএস দাবি করে যে ১৯৩৪ সালে ওয়ার্ধা আশ্রম থেকে গাঁধী গিয়েছিলেন তাঁদের একটি শাখা দেখতে আর তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কিন্তু গাঁধীর সঙ্গে সম্পর্ক যে কখনোই মধুর ছিল না, তা নথি ঘাঁটলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যাওয়া যাক সরাসরি ১৯৪৭-এর অগস্ট মাসে। আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ জানাল যে নতুন ভারতের জাতীয় তেরঙা পতাকা কখনওই হিন্দুদের আপন, শ্রদ্ধার হয়ে উঠবে না। ‘তিন’ শব্দটাই অশুভ এবং তিন বর্ণবিশিষ্ট জাতীয় পতাকা নিশ্চিত ভাবেই খুব খারাপ, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। ‘অর্গানাইজার’-এর ১৭ ও ২২ জুলাই সংখ্যাতেও এমন আরও অনেক জাতীয় বিষয়ে আরএসএস-এর বিরোধিতার কথা লেখা। এমনকি, আরএসএস-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘ-চালক, এম এস গোলওয়ালকর তাঁর বই ‘বাঞ্চ অব থটস’-এ আক্ষেপ করেছেন ভারত কেন আরএসএস-এর গৈরিক চেরা পতাকাকে রাষ্ট্রীয় বলে মেনে নিচ্ছে না। আরএসএস আরও চেয়েছিল মনুস্মৃতিকে ভারতের সংবিধান বলে গ্রহণ করা হোক।
এই ভাবে স্বাধীনতার পর প্রায় ১৮ মাস ধরে আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা গাঁধী ও তাঁর সমর্থকদের প্রচণ্ড গাল দিয়ে তাদের বিরোধ চালিয়ে গেল। আরএসএস এক দিকে উদ্বাস্তুদের মধ্যে কিছু সেবা করল ঠিকই কিন্তু তাঁদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খুনোখুনি শুরু করল। গাঁধী অবশ্য এই সময় ব্যস্ত ছিলেন পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের ক্ষোভকে একটু শান্ত করতে আর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সামলাতে। সবাই স্বীকার করেছে যে স্বাধীনতা ও দেশ বিভাজন ঘোষণার ঠিক পরই যে কলকাতায় কোনো বিধ্বংসী খুনোখুনি হয়নি, তার জন্যে মহাত্মাকে কৃতিত্ব দিতে হবে। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার এই আত্মশক্তির অদ্ভুত নিদর্শনকে লিখিত ভাবে ব্যঙ্গ করেছিল আর গাঁধীকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণও। তা সত্ত্বেও যখন আরএসএসের প্রধান গুরু গোলওয়ালকর দেখা করতে চাইলেন, তিনি রাজি হলেন আর ১৯৪৭-এর ৯ সেপ্টেম্বর তাঁরা সামনে বসে আলোচনা করলেন। গাঁধী যখন সোজাসুজি তাঁকে বললেন যে সঙ্ঘের হাত রক্তে মাখা, গোলওয়ালকর উচ্চ সুরে তা অস্বীকার করলেন। ১৬ সেটেম্বর তারিখে তিনি দিল্লির ভাঙি কলোনিতে অবস্থিত আরএসএসের একটি শাখায় গিয়ে তাঁর শান্তির বাণী প্রচার করেন, যা বর্তমান সরকার তাঁর মানপত্র হিসেবে বিবেচনা করে। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এই সময়কার পুলিশ দপ্তরের অগণ্য লেখা উত্থিত করে অবশ্য বলেছেন যে সঙ্ঘ পরিবার দাঙ্গায় শুধু নেতৃত্ব দেয়নি, তাঁরা লাগাতার গাঁধী ও স্বাধীন সরকারের জুগুপ্সা চালিয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের গাঁধী বিদ্বেষ আরও ধারালো ছিল আর সাংগঠনিক শক্তি অনেক বেশি ভয়াবহ। এই সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার কিন্তু এক সময় গাঁধীকে অনুসরণ করতেন এবং তার জন্যে শাস্তিও পেয়েছিলেন। তিনি অবশ্য গাঁধীর মুসলমান প্রীতি একেবারেই মানতে নারাজ, তাই সাভারকরের কাছে চলে গেলেন।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গাঁধীর হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই পটেল আরএসএস ও মহাসভাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। তাঁদের নেতাদেরও কারারুদ্ধ করলেন দেড় বছর। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মৃদু আবেদন বা গোলওয়ালকরের প্রচুর ক্ষমাপ্রার্থনা তিনি মানলেন না। নেহরুকে লেখা তাঁর চিঠিগুলি থেকে দেখা যায় যে হিন্দু মহাসভার এক উগ্র সমর্থক এই হত্যা করেছে। কিন্তু এই ঘৃণ্য কাজ করতে সুবিধে করেছে আরএসএসের আর মহাসভার বিষাক্ত প্রচার আর দেশ বিভাজনের দায়িত্ব গান্ধীর ওপর ন্যস্ত করার অপপ্রচার। তিনি নেহরুর সর্বদলীয় সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদবাবুকে বেশ কয়েক বার সাবধান করেছেন এবং রাগের সঙ্গে জানিয়েছেন যে সঙ্ঘ পরিবার মহাত্মার খুনের পর মিষ্টি বিতরণ করেছিল। পটেল জুলাই, ১৯৪৯ অবধি এই দুই সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলেন না আর কাউকে জেল থেকেও ছাড়লেন না। সর্দার পটেল অনড় রইলেন যতক্ষণ না সঙ্ঘ পরিবার মুচলেকা দিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করল।
সর্বশেষে বুঝে নিই কমিউনিস্ট পার্টি গান্ধীকে ঠিক কী চোখে দেখছিল। এক কথায় তাদের কখনো নরম কখনো গরম আচরণ সম্পূর্ণ ভাবে নির্ধারিত করত সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টি — আন্তর্জাতীয় কমিউনিস্ট সংস্থা বা কমিনটার্নকে সামনে দাঁড় করিয়ে। ১৯২১-এ আমেদাবাদে অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেসের অংশ হয়ে কমিউনিস্টপন্থীরা প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন — মূল দলের নয় বছর আগে। যেখানে দেখা যায় আরএসএস রাজশক্তির বিরুদ্ধে একটিও আন্দোলন করেনি, কমিউনিস্টরা কিন্তু তাদের ১৯২০-র দশক থেকেই শাসক বিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। ইংরেজ গোয়েন্দা পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে তিনটি বড় ষড়যন্ত্র মামলা (পেশাওয়ার, কানপুর ও মীরাট) দায়ের করেছিল এবং অনেক নেতাদের কারাগারে আটকে রেখে ছিল। পরের দশকেও কমিউনিস্টরা গাঁধীর কংগ্রেসকে বুর্জোয়া আর পুঁজিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করলেও জাতীয় আন্দোলন তাদের মতন করে চালিয়ে গেছে। অনেক নেতাদের বার বার জেলেও যেতে হয়েছে। এই সময় পার্টির উপর কমিনটার্ন নির্দেশ দিল পপুলার ফ্রন্ট গড়ে তুলতে, সব স্তরের অ-কমিউনিস্ট দল বা গোষ্ঠীদের নিয়ে অতএব পার্টি গাঁধীর সঙ্গেও কাজ করতে তেমন বাধা ছিল না কিন্তু গাঁধী কমিউনিস্টদের সশস্ত্র পথ কখনোই মানেননি বা স্বীকৃতি দেননি।
সব উল্টে গেল যে মুহূর্তে হিটলার রুশ আক্রমণ করল। কমিনটার্ন ভারতীয় কমিউনিস্টদের জানাল যে ব্রিটিশ সরকার রুশের পাশে দাঁড়িয়েছে, অতএব তাঁরাও যেন ওই সরকারকেই সমর্থন করে। তার পর ভারতীয় কমিউনিস্টদের নীতি ও আচরণ পুরোপুরি বদলে গেল। তাঁরা ব্রিটিশ সরকারের দোস্ত হয়ে উঠল আর গাঁধীর ১৯৪২-এর আন্দোলনের বিরোধিতা করলেন। পি সি জোশির নেতৃত্বে ও সি পি আইয়ের ভূমিকা অতি নিন্দনীয়। তাঁরা ইংরেজ সরকারের সাহায্য নিল আর তার বিনিময়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিভিন্ন রকমের মদত দিল। ব্রিটিশদের দাক্ষিণ্যে প্রচুর কমরেড জেল থেকে মুক্তিও পেল, কিন্তু মানুষের চোখে একদম পড়ে গেল। পরে অবশ্য তাঁরা এই দুর্নাম কিছুটা মেটাবার চেষ্টা করল প্রতিবাদী কর্মসূচি নিয়ে। ১৯৪৬-এ অনেক জায়গায় ধর্মঘট করে তাঁরা ব্রিটিশ রাজকে যথেষ্ট কাবু করলেন। এমনকি বম্বেতে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির বিদ্রোহতেও তাঁরা জড়িয়ে ছিলেন।
এই লেখার মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করেছি তৎকালীন পরিস্থিতি সংক্ষেপে একটু বুঝতে। ৩ অক্টোবর থেকে গাঁধী আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাবেন আর তাঁকে নিয়ে যতটুকুও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, তা না থাকারই সম্ভাবনা বেশি। একটা উৎসাহজনক প্রবণতা দেখে ভালোই লাগছে আর সেটা হল আগে যাঁরা তিক্ত গাঁধী বিরোধী ছিলেন, তাঁরাও এখন কিছুটা চেষ্টা করছেন এই অনন্য ব্যক্তিকে জানতে।