আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলিতে ভাই ফোঁটার কথা বিশেষ পাওয়া যায় না। এটি নিতান্তই লৌকিক আচার, সাধারণ মানুষই পালন করে এসেছেন।
ভাইবোনের পরস্পর প্রীতি জানানোর জন্য ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা রক্ষাবন্ধনের মতো অনুষ্ঠান ভারতের বাইরে বিশেষ কোথাও নেই। ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উত্তর ভারতে ভাই দুজ নামে পরিচিত, বাংলায় ভাই ফোঁটা, মহারাষ্ট্র, গুজরাত ও কোঙ্কণ এলাকায় ভাই বীজ বা ভাউ বীজ। নেপালে ভাই টীকা তো প্রায় দশমী বা দশেরার মতো বড় ব্যাপার। দক্ষিণ নেপালে একে যম দ্বিতীয়াও বলা হয়। বাংলায় কালী পুজো আর ভাই ফোঁটা দু’দিনের ব্যবধানে পড়লেও দুটো একেবারে আলাদা অনুষ্ঠান, কিন্তু ভারতের বেশির ভাগ জায়গায় এটি পাঁচ দিনের দীপাবলির একটি অঙ্গ। অনেক শতাব্দী ধরে বোনেরা একটি ছোট্ট আরতি করে ভাইয়ের কপালে টীকা লাগিয়ে দেন, সেটি হল অমঙ্গলের প্রতিরোধে রক্ষাকবচ।
আমরা শুনে এসেছি, নরকাসুরকে যুদ্ধে হারিয়ে শ্রীকৃষ্ণ অক্ষত দেহে ফিরে আসার পরে আনন্দিত সুভদ্রা ভাইয়ের কপালে পবিত্র তিলক পরিয়ে দিয়েছিলেন, এ থেকেই ভাই ফোঁটার উদ্ভব। তিলকটা অবশ্য যুদ্ধের আগে পরালেই ভাল হত। তবে, ভবিষ্যপুরাণ, ভাগবতপুরাণ ও বিষ্ণুপুরাণে রাখিবন্ধনের নানা উল্লেখ থাকলেও আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলিতে ভাই ফোঁটার কথা বিশেষ পাওয়া যায় না। এটি নিতান্তই লৌকিক আচার, সাধারণ মানুষই পালন করে এসেছেন। কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুরোহিত ও দক্ষিণার ব্যবস্থা না থাকলে শাস্ত্রগুলি তা নিয়ে সচরাচর মাথা ঘামায়নি।
কথিত আছে, এই দিনটিতে বোন যমুনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন মৃত্যুর দেবতা যম। প্রাচ্যবিদ হোরেস উইলসন দুশো বছরে আগে লিখেছিলেন, বোনেরা বিশ্বাস করেন, ভাই ফোঁটা দিলে ভাইয়ের আয়ু বাড়বে এবং তাদের জীবনের উপর যমরাজের কোনও ক্ষমতা থাকবে না। তিনি যে লাইনগুলি উদ্ধৃত করেছিলেন, সেগুলি আজও বোনেরা উচ্চারণ করেন: ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। তিনি এই দিনের সবচেয়ে দারুণ ব্যাপারটাও ঠিক ঠিক খেয়াল করেছেন: বোনেরা ভাইদের রকমারি সুখাদ্য পরিবেশন করেন, ভাইরা তাঁদের জামাকাপড় ও টাকা দেন। এক শতক আগে ব্রিটিশ গবেষক মুরিয়েল ম্যারিয়ন আন্ডারহিল লিখেছিলেন: এই দিনে যম নিজের বাড়ি বন্ধ করে বোনের কাছে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করেন, তাই এ দিন মারা গেলে কাউকে যমের বাড়িতে যেতে হয় না। উপহার এবং ভূরিভোজের কথা তিনিও বলেছেন, তার সঙ্গে এটাও লিখেছেন যে, অনেকে মধ্যাহ্নে যমের মূর্তির আরাধনা করেন এবং সুযোগ পেলে যমুনা নদীতে স্নান করেন।
সুকুমারী ভট্টাচার্য ইন্ডিয়ান থিয়োগনি গ্রন্থে লিখেছেন, আদিতে যম-যমীকে যমজ বলেই দেখা হত। ক্রমশ যমের চরিত্র জটিল হল, তিনি অশুভ শক্তি হিসেবে গণ্য হলেন, যমীও পরিণত হলেন অমঙ্গলের দেবী নির্তি-তে, কৃষ্ণবর্ণ অনার্য দেবীর রূপ ও ভাব পরিগ্রহ করলেন তিনি।
সুকুমারী ভট্টাচার্য ইন্ডিয়ান থিয়োগনি গ্রন্থে লিখেছেন, আদিতে যম-যমীকে যমজ বলেই দেখা হত। ক্রমশ যমের চরিত্র জটিল হল, তিনি অশুভ শক্তি হিসেবে গণ্য হলেন, যমীও পরিণত হলেন অমঙ্গলের দেবী নির্তি-তে, কৃষ্ণবর্ণ অনার্য দেবীর রূপ ও ভাব পরিগ্রহ করলেন তিনি। সুকুমারী দেখিয়েছেন, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-এর এই যমী কী ভাবে পুরাণের যমুনা নদীতে পরিণত হন, যে কালো যমুনার অন্য নাম কালিন্দী। সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের আদি আর্যরা মালবা মালভূমিতে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু যমুনা পার হওয়ার অনেক সমস্যা ছিল। অতএব যমুনা নিয়ে নানান কাহিনিতে ভয় আর রহস্যের ছড়াছড়ি। কিন্তু যমুনা এবং গঙ্গা পার হওয়ার পরে আর্যরা গঙ্গা-যমুনা দোয়াবেই তাঁদের আসল আর্যাবর্ত প্রতিষ্ঠা করলেন।
এখানে বলা দরকার, রক্ষাবন্ধন অনুষ্ঠানটি খুব সম্ভবত নাগপঞ্চমী থেকে এসেছে। এটি সচরাচর ভরা বর্ষায় পালিত হয়, ঠিক যে সময় সাপের উত্পাত খুব বেশি হত, তাই বোনেরা সাপের কামড় থেকে ভাইদের রক্ষা করার জন্য এই তিথি পালন করত। হেমন্ত বা প্রথম শীতে সাপের ভয় অনেক কম। কিন্তু ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নানা আধিব্যাধি আসে, তাদের হাত থেকে ভাইদের রক্ষা করতেই ভাই ফোঁটার প্রচলন হয়ে থাকতে পারে। আধুনিক চিকিত্সা ও ওষুধপত্র এসে অবশ্য যমের প্যাঁচপয়জার কিছুটা বানচাল করে দিয়েছে। বস্তুত, আশ্বিন-কার্ত্তিকে নানা উত্সবে ভূত প্রেত ডাকিনী যোগিনী ইত্যাদিদের প্রাদুর্ভাব, ভাই ফোঁটায় যমের দুয়ারে কাঁটা দিয়ে সেই পর্ব বছরকার মতো শেষ হয়। প্রসঙ্গত, দক্ষিণ ভারতে দেওয়ালির কয়েক দিন পরে ‘কার্ত্তিকেয় দীপম্’ অনুষ্ঠানে বোনেরা আরও এক বার প্রদীপ জ্বালান, ভাইয়ের মঙ্গলকামনায়।
আমেরিকানরা ইদানীং সিস্টার্স ডে এবং ব্রাদার্স ডে শুরু করেছেন, ‘ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স ডে’-ও। তবে এ সবই হল কার্ড ও উপঢৌকনের ব্যবসার স্বার্থে, আমাদের প্রাচীন লোকপ্রথার সঙ্গে এর তুলনা চলে না। কিন্তু ভারতে ভাই ফোঁটার এতটা জনপ্রিয়তা কেন? অসুখবিসুখ থেকে রক্ষা করার আদি তাগিদটা তো অনেক দিনই কমে গিয়েছে! সম্ভবত মেয়েদের অনেক দূরে বিয়ে দেওয়ার প্রথার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। কাছাকাছি সম্বন্ধ করলে স্বগোত্রে বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, তাতে জিনগত কারণে বংশের স্বাস্থ্যহানি হতে পারে, তাই ‘জাতি-গোত্র’ খুঁটিয়ে বিচার করে পাত্র ঠিক করা হত, সাধারণত দূরদেশে। কিন্তু বোন অনেক দূরে থাকলে ভাইয়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত্ হবে কী করে? দেখা না হলে পারিবারিক বন্ধন অটুট থাকবে কেন? অতএব এমন অনুষ্ঠান দরকার, যাতে বছরে একটা দিন অন্তত ভাইবোনের দেখা হয়। আর, বাঙালি ভাইরা যত অলসই হোক, পরম যত্নে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার লোভ দেখালে না এসে যাবে কোথায়?