নীলকণ্ঠের মতো শুধু ব্যাড বা বিষাক্ত লোন গ্রাস করলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির লোকসান কমে যাবে এবং তাদের হিসাবপত্র পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারপরে যখনই এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির এ্যাকাউন্টস আবার ঝকঝকে হয়ে উঠবে, তখনই মোদী তার প্রিয় ধনকুবেরদের কাছে সেগুলি বেচে দিতে পারবেন।
গত 15 সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদীর সরকার হঠাৎ একটি ‘Bad Bank’ ঘোষণা করল আর মন্ত্রিসভা একইসঙ্গে এই অদ্ভুত ব্যাঙ্কের খাতে বিপুল 30,600 কোটি টাকার সরকারি গ্যারান্টি অনুমোদন করল। এই ব্যাঙ্কের আসল নাম National Asset Reconstruction Company Limited, সংক্ষেপে এনএআরসিএল। বাংলায় তর্জমা করলে যার অর্থ হয় জাতীয় সম্পদ পুনর্গঠন সংস্থা। এই সংস্থার কাজ হল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বড় বড় Bad বা অনাদায়ী ঋণ কিনে নেওয়া। নীলকণ্ঠের মতো শুধু ব্যাড বা বিষাক্ত লোন গ্রাস করলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির লোকসান কমে যাবে এবং তাদের হিসাবপত্র পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারপরে যখনই এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির এ্যাকাউন্টস আবার ঝকঝকে হয়ে উঠবে, তখনই মোদী তার প্রিয় ধনকুবেরদের কাছে সেগুলি বেচে দিতে পারবেন।
এটি একেবারেই নিছক কল্পনা নয়। কারণ গত সাত বছরে এই ব্যবসায়ীদের সাহায্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁদের প্রচুর সুবিধা করে দিয়েছেন। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী মোদীর প্রথম পাঁচ বছরের শাসনকালেই মুকেশ আম্বানি তাঁর সম্পদ 1.68 লক্ষ কোটি টাকা থেকে 3.65 লক্ষ কোটি টাকায় নিয়ে যেতে সফল হয়েছেন। অর্থাৎ, তাঁর সম্পত্তি বৃদ্ধির পরিমাণ দ্বিগুনেরও বেশি, প্রায় 118 শতাংশ! মনে পড়ে 2014 সালে নির্বাচন জেতার পর নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে পৌঁছেছিলেন গৌতম আদানির ব্যক্তিগত মিমানে চড়ে। তাঁর কাছ থেকে মোদী যে প্রচুর সাহায্য পেয়েছেন, দু’পক্ষের কেউই তা গোপন করেননি। 2014 থেকে 2019 সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ মোদী শাসনের প্রথম অধ্যায়ে আদানির ধনসম্পত্তির পরিমাণ 50.4 হাজার কোটি টাকা থেকে 1.1 লক্ষ কোটি, অর্থাৎ 121 শতাংশ বেড়েছে। কার আশীর্বাদে এই চমত্কার ব্যাপারটি হওয়া সম্ভব হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। একটি নতুন ব্যাঙ্কের লাইসেন্সের জন্য আম্বানিরা অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছেন। এখন তাঁরা একটি ঋণমুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক পেলেও পেতে পারেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বিগত 5 বছর ধরে লাগাতার লোকসান দেখাতে হয়েছে। তারা যতই লাভ করে থাকুক না কেন, তাদের অনাদায়ী ঋণের জন্যে হিসাবের খাতায় প্রচুর প্রভিশন বা সংস্থান রাখতে তারা বাধ্য হয়েছে। আর তার ফলে প্রতি বছরেই ক্রমাগত লোকসান দেখিয়ে এসেছে তারা। যেমন 2019-20 আর্থিক বছরে ব্যাঙ্কগুলি প্রায় 1 লক্ষ 75 হাজার কোটি টাকার লাভ করেও দিনের শেষে তারা 26 হাজার কোটি টাকার ক্ষতি দেখাতে বাধ্য হয়েছে। এর কারণ হল তাদের অনাদায়ী ঋণের খাতে 2 লক্ষ কোটি টাকার বেশি রাখতে হয়েছে। এই ঋণের বোঝা দেখিয়ে ব্যাঙ্কগুলিকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় ঠিকই, কিন্তু তাদের বিক্রি করা যায় না। অতএব, গত আর্থিক বছরে হঠাৎ ব্যাঙ্কগুলির 31,817 কোটি টাকার লাভ দেখানো হয়েছে। কিন্তু যত স্বজনপোষণ করাই হোক না কেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি এখনও 6 লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অপ্রাপ্য দায় বা অনুৎপাদক সম্পদ (Non-Performing Assets) বহন করে চলছে। অতএব সরকারের পরিকল্পনা হল, এই নতুন এনএআরসিএল ব্যাঙ্কের মাধ্যমে এর একটি বড় অংশ বার করে নিয়ে যাওয়া। তবেই নরেন্দ্র মোদী ধাপে ধাপে আমাদের বৃহৎ ব্যাঙ্ক এবং তাদের লক্ষ লক্ষ কাস্টমার ও শাখাগুলি নিলাম করে তাঁর প্রিয় ব্যবসায়ীদের হস্তান্তর করতে পারবেন। ঠিক যেভাবে তাঁরা বিনা মেহনতে দেশের একাধিক এয়ারপোর্ট, সমুদ্রবন্দর, জাতীয় সড়ক ও টোল ব্রিজ পেয়েছে। সেইভাবেই এবার তাঁরা ব্যাঙ্কও পেতে চলেছে।
সরকার বারংবার বলে যাচ্ছে যে, এই দেউলিয়া ঘোষণা করার কারণ কেবলমাত্র ব্যাঙ্ক এবং কোম্পানিদের নিজেদের খাতা ও হিসাব পরিষ্কার রাখার জন্য, ঋণ ফেরতের জন্য নয়। আমাদের মৌলিক প্রশ্ন হল, বড় বড় শিল্পপতিদের ব্যবসা যখন দেউলিয়া বলে চিহ্নিত করে তাদের দায়মুক্ত করে দেওয়া হয়, তখন মালিকদের দেউলিয়া ঘোষণা করা হয় না কেন?
15 সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা নতুন এনএআরসিএল ব্যাঙ্কের জন্যে 30,600 কোটি টাকার গ্যারান্টি মঞ্জুর করেছে। এই সংস্থাটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স পেলেই সরকারি ব্যাঙ্কগুলির কাছ থেকে বড় মাপের ঋণগ্রস্ত বা রুগ্ন সংস্থাগুলি কিনতে আরম্ভ করবে। এনএআরসিএল মাত্র 15 শতাংশ মূল্য দেবে, আর বাকি অর্থের বিনিময়ে তারা দেবে সরকারি গ্যারান্টি। তারপর তারা আবার একটি নতুন সম্পদ পুনর্গঠন কোম্পানির মারফত এগুলিকে ঋণের বোঝা সমেত বিক্রি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু মোদী সরকার এর আগেও এইসব ঋণগ্রস্ত সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা করেছে। গত পাঁচ বছর ধরে দেউলিয়া আইন লাগু করে অনেক রকমের কার্যকলাপ চালানো হয়েছে। এই বছরের জুন অবধি এই 4541টি দরখাস্তের মধ্যে মাত্র 324টি ক্ষেত্রে কিছু মীমাংসা সম্ভব হয়েছে, আর 1349টি সম্পূর্ণ দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছে। কোম্পনিগুলি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করাতে পারলে তাদের কাছ থেকে দেনার অতি কম অংশই ফেরত পাওয়া যায়। ব্যাঙ্কগুলি তাদের মোট প্রাপ্যের 25 থেকে 33 শতাংশ পেলেই নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছে। ভিডিওকনের মতো নামকরা সংস্থাকে এক ধনকুবেরের কাছে বিক্রি করা হল, তাদের কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণের মাত্র 4 শতাংশ মূল্যে দিয়ে। জেট এয়ারওয়েজের ক্ষেত্রে 7808 কোটি টাকার ঋণ প্রায় সম্পূর্ণ ছেড়ে মাত্র 385 কোটি টাকা, অর্থাৎ 5 শতাংশ মূল্যে নতুন মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রুচি ইন্ডাস্ট্রিজের ক্ষেত্রে বাবা রামদেবের পতঞ্জলি আয়ুর্বেদের কাছে সংস্থাটি হস্তান্তরের জন্যে ব্যাঙ্কের 93.5 শতাংশ ঋণ মকুব করা হল। এই রকম প্রচুর উদাহরণ আছে।
সরকার বারংবার বলে যাচ্ছে যে, এই দেউলিয়া ঘোষণা করার কারণ কেবলমাত্র ব্যাঙ্ক এবং কোম্পানিদের নিজেদের খাতা ও হিসাব পরিষ্কার রাখার জন্য, ঋণ ফেরতের জন্য নয়। আমাদের মৌলিক প্রশ্ন হল, বড় বড় শিল্পপতিদের ব্যবসা যখন দেউলিয়া বলে চিহ্নিত করে তাদের দায়মুক্ত করে দেওয়া হয়, তখন মালিকদের দেউলিয়া ঘোষণা করা হয় না কেন? কোটিপতিরা তো দিব্যি তাদের বিশাল ধনসম্পত্তি তাঁদের অন্য সংস্থার নামে ভোগ করে যান, আর নতুন নতুন দরখাস্ত পিছু আবার শত শত কোটি টাকার ঋণও পান। এই লোকসান ছাড়াও যাঁরা সরাসরি প্রতারণায় হাতে নাতে ধরা পড়েন, তাঁরা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগও পেয়ে যান। বিগত 8 বছরে ব্যাঙ্কগুলি থেকে মোট 10.8 লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করা হয়েছে, মানে এত পরিমাণ টাকা এই অপ্রাপ্য ঋণের নামে ব্যাঙ্কগুলি লোকসান করেছে। 2011-12 থেকে 2019-20 অবধি দেশের ব্যাঙ্কগুলিকে এত লোকসান আর প্রতারণার ধাক্কা সামলাতে হয়েছে যে, ভারত সরকার তাদের প্রতি বছর নতুন করে মূলধন বা পুঁজি দিতে বাধ্য হয়েছে। এই বিপুল 3 লক্ষ 85 হাজার কোটির মধ্যে মনমোহন সিংহের 5 বছরে 45 হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে, আর মোদীর 5 বছরে 3 লক্ষ 20 হাজার কোটি টাকা। এই মগের মুলুকের সংখ্যাগুলি কিন্তু বহু রাজ্যের বাৎসরিক বাজেটের থেকে অনেক বেশি। আর সম্পূর্ণ টাকাগুলি আপনার ও আমার, তা ব্যাঙ্কগুলি এগুলিকে তাদের সরাসরি লোকসান হিসাবেই দেখাক বা সরকারি অনুদান হিসাবেই দেখাক। শুধু কর্পোরেট মালিকদের স্বার্থ বাঁচানো ছেড়ে সরকারের উচিত আমানতকারীদের ও কর্মচারীদের কথাটাও ভাবা। আসলে এই নতুন Bad Bank বা এনএআরসিএল দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় মোদী সরকার সত্যিই কাকে অগ্রাধিকার দিতে চায়।