সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা বা হিংসা বাঙালির ধাতে খুব একটা নেই। তাই তাকে তাতিয়ে তুলতে দুষ্টশক্তিদের চিরকালই বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখা দরকার, হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির দেবতাদের আমদানি করে কী ভাবে চৈত্রের তপ্ত বাংলাকে আরও উত্তপ্ত করে তোলা হচ্ছে। বঙ্গভূমিতে এই মাসটা শিবের গাজনের মাস। এমন শিব তো ভূভারতে আর কোথাও নেই! কৈলাসের অধীশ্বরকে আমরা শিবায়নের পদ্য শুনিয়ে আমাদের মধ্যে ডেকে এনেছি, তাঁকে গামছা পরিয়েছি, আমাদের শিবের পিছনে তাঁর স্ত্রী সারা দিন ঝাঁটা হাতে তাড়া করে বেড়ান। ঠিক যেমন আমাদের দুর্গা ছেলেমেয়ে নিয়ে ফি-বছর বাপের বাড়ি আসেন— কেবল সঙ্গে মহিষাসুরটিকে আনতে ভোলেন না, সে হল তাঁর আধার কার্ড! কিন্তু এ বার রাম এসে শিবকে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। আমাদের বসন্ত এবং বাংলার অন্নপূর্ণা, কিংবা মা শীতলাও কি তবে বিদায় নেবেন? তাঁদের জায়গা দখল করবে বুক-কাঁপানো বাইক বাহিনী আর হাড়-হিম-করা অস্ত্রসম্ভার?
রামচন্দ্র সীতার খোঁজে এ তল্লাট মাড়িয়েছিলেন বলে কখনও শুনিনি, হনুমানও কোনও দিন বঙ্গদর্শন করেননি। অথচ হঠাৎ রামনবমী আর হনুমান জয়ন্তী নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড বেধে গিয়েছে, হিন্দুত্বের আঁচে সাম্প্রদায়িক বিরোধ জ্বাল দিয়ে অশান্তি সৃষ্টির তৎপরতা চলছে। আটশো বছর ধরে চলে-আসা মহরমের রীতির দোহাই পেড়ে একদল লোক দাবি তুলছে, রামনবমীতে তাদেরও অস্ত্র নিয়ে মিছিল করার অনুমতি দিতে হবে!
রামের ব্যাপারটা সরকার সামলাক, আমরা বরং হনুমানের দিকে একটু নজর দিই। আমরা জানতাম তাঁর জন্ম চৈত্রপূর্ণিমায়, যদিও তামিল এবং মালয়ালিরা বলেন তিনি নাকি পৌষ মাসে জন্মেছিলেন। সে-কালে বার্থ সার্টিফিকেট নিয়ে এত কড়াকড়ি ছিল না, তাই জন্মের সাল-তারিখ নিয়ে নানা মত থাকতেই পারে। কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার জানা দরকার। হনুমান কি বায়ুপুত্র, ষোড়শ শতকে লেখা একনাথ-এর ভাবার্থ রামায়ণ-এ যেমনটি বলা আছে? না কি, হনুমান চালিসা-র কথাই ঠিক, তিনি শিবের ছেলে? তবে একটা বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। হনুমান অমিত শক্তি ও সামর্থ্যের ভান্ডার, গদা এবং অন্যান্য স্বর্গীয় অস্ত্রশস্ত্র তিনি খেলাচ্ছলে ব্যবহার করেন। তিনি অনায়াসে পাহাড়পর্বতকে উপড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন, ইচ্ছা মতো যে কোনও রূপ ধারণ করতে পারেন। তিনি অতি দ্রুতবেগে বাতাসে ভেসে যান, পুষ্পক রথ রামের হাতে আসার আগে অনেকবার তাঁকে আকাশভ্রমণও করিয়েছেন। বেচারি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসকে হয়তো অচিরেই এ বিষয়ে গবেষণা করতে বলা হবে।
রসঙ্গত, সিন্ধুসভ্যতায় রাম বা হনুমানের কোনও উল্লেখ নেই, বেদেও তাঁদের দেখা মেলে না। কোনও কোনও অত্যুৎসাহী পণ্ডিত ইন্দ্রের প্রিয় বাঁদর বৃক্ষকপিকে হনুমানের সঙ্গে তুলনা করতে চেয়েছেন বটে, কিন্তু দু’জনের সাংস্কৃতিক ডিএনএ-তে মোটেই কোনও মিল নেই। রামের লঙ্কা অভিযানের কাহিনি এসেছে অনেক পরে, লঙ্কার ভৌগোলিক অবস্থানও কালক্রমে পালটেছে। প্রাক্-আর্য বা দ্রাবিড় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে রামের আরাধনার কোনও প্রচলন ছিল বলে জানা যায় না। বস্তুত, দক্ষিণ ভারতে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি উত্তর ভারত তথা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তার নায়ক পেরিয়ার এবং তাঁর অনুগামীরা প্রবল অভিযোগ করেছিলেন যে, রামায়ণে দক্ষিণ ভারতের অপমান করা হয়েছে। উনিশ শতকের ভারতবিদ এডওয়ার্ড মুর-এর বক্তব্য, ‘ভারতে একটা প্রচলিত ধারণা ছিল যে, শ্রীলঙ্কায় বানর এবং রাক্ষসরা বাস করে, (তাই) পুরোহিত ও কবিরা রামের অভিযানের কথা লেখার সময় মহাকাব্যে সেই জনপ্রিয় ধারণা ও বিশ্বাসের একটা প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।’ এইচ সি লাল আবার বলেন, ওরাওঁ বা ভ্রাওঁ জনজাতিকে বানর নামটি দেওয়া হয়েছিল, যদিও অন্য অনেকের মতে এটিতে যে কোনও অস্ট্রিক বা নেগ্রিটো জনজাতির কথা বোঝায়।
এই আর্য-বানর সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক টানাপড়েন ও সমবায় খুবই কার্যকর হয়েছিল, এবং লঙ্কার শক্তিশালী দ্রাবিড়দের হারানোর কাজে বানররা যে সাহায্য করেছিল তার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হিসাবেই সবচেয়ে অনুগত ও সুসংস্কৃত বানর হনুমানকে হিন্দুধর্মের ক্যাবিনেটে আসন দেওয়া হয়। আর্য ভারতের সর্বত্র বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্মের প্রবল জনপ্রিয়তার তাড়নায় পর্যুদস্ত ব্রাহ্মণ্যধর্মের মহিমা ফিরিয়ে আনতে প্রায় চারশো বছর ধরে বাল্মীকিদের বিস্তর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। রামায়ণ যে নতুন হিন্দুধর্মের কথা বলল, তাতে জটিল আচার এবং মন্ত্রতন্ত্রের ভূমিকা অনেক কম, এবং সেখানে এমন নানা আরাধ্য দেবতাকে নিয়ে আসা হল যাঁরা অনেক বেশি মানবপ্রতিম। প্রসঙ্গত, রাম কিন্তু হনুমানকে অনেকবার বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, এ-কালের নেতা যে-ভাবে কেবল বিদেশিদের আলিঙ্গন করে থাকেন। বর্ণাশ্রম ও জাতপাতের ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ হাঁসফাঁস করছিলেন, ব্রাহ্মণ্যবাদের এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে দলে দলে বৌদ্ধধর্মের আশ্রয় নিচ্ছিলেন। ‘নীচের তলার’ বানরের প্রতি রামের এই প্রীতি তাঁদের খুব ইতিবাচক একটা বার্তা দিয়েছিল। ভক্তি, শুদ্ধা ভক্তিই সব— নতুন মানবিক হিন্দুধর্মের এই বার্তার প্রতীক হিসাবে উদ্ভাসিত হলেন রামভক্ত হনুমান।
হিন্দুধর্মের এই উন্নততর সংস্করণে রামকে ভীম বা দুর্যোধনের মতো মাথা-গরম আর্যপুত্র হিসাবে দেখানো হয়নি, তিনি বরং এখানে অত্যন্ত শান্ত, নরম ধাতের মানুষ। এর কারণ, এই রাম অনেকটা বুদ্ধের আদলে গড়া। আমরা এ-বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারি যে, এই ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ কখনওই চাইতেন না, বাংলার স্কুলপড়ুয়ারা তলোয়ার হাতে রাস্তায় নামুক। দুটো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন এগিয়ে আসছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে রাম বা হনুমানকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্তিপরীক্ষার তাড়নায় এতগুলো প্রাণ বিনষ্ট করার কোনও নৈতিক অধিকার রাজনৈতিক দলগুলির থাকতে পারে না।
রামায়ণের এই নবরূপ সৃষ্টির পাঁচ থেকে সাতশো বছরের মধ্যে শঙ্করাচার্যের মতো ধর্মনায়করা এমন ব্যবস্থা করলেন, যাতে লোকে বৌদ্ধধর্মকে ভুলে যায়। এই সময়ে আরও বেশ কিছু অনার্য দেবতাকে হিন্দুধর্মে ঠাঁই দেওয়া হল, স্থান পেল কিছু পশুপাখিও। এমনকী বিরোধী নেতা বুদ্ধও দশাবতারের তালিকায় ঢুকে পড়লেন, এবং রামচন্দ্রের বেশ কাছেই আসন পেলেন তিনি। মধ্যযুগে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লেখা রামায়ণ এবং কৃষ্ণকথাগুলির মাধ্যমে ভক্তি আন্দোলনের প্রসার ঘটল, রামভক্ত হনুমান এবং শ্রীকৃষ্ণের রাধা হয়ে উঠলেন ভক্তির প্রতীক। ভ্রাতৃত্ব এবং আনুগত্যের প্রবল শক্তিকে সামনে রেখে ভক্তিমার্গে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখালেন রামানন্দ, নিম্বার্ক, নামদেব, সুরদাস, কৃত্তিবাস এবং, অবশ্যই, তুলসীদাস। প্রসঙ্গত, ইসলামে ধর্মান্তর সবচেয়ে বেশি ঘটল বাংলা, পঞ্জাব এবং কাশ্মীরে— রাম-হনুমানের যেখানে বিশেষ কোনও জায়গাই ছিল না।
এখন, রাম শান্তিকামী হতে পারেন, কিন্তু একজন যোদ্ধা নেতার দরকার হলই, বিশেষ করে রাজপুতানা বা বিজয়নগরের হিন্দু প্রধানদের, এবং মরাঠা নেতাদের, যাঁরা ‘হর হর মহাদেব’ এবং ‘জয় বজরংবলী’ হাঁক দিয়ে মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামলেন। হনুমানের চাহিদা বাড়ল, দিকে-দিকে আখড়ার ছড়াছড়ি হল। কুস্তিগিরদের আরাধ্য এই দেবতাকে একটা কারণে আমরা ধন্যবাদ জানাতেই পারি— তাঁর প্রেরণাতেই এতগুলো সোনা আর রুপোর পদক ভারতে এসেছে।
ক্রমে-ক্রমে হনুমানের আরও নানা গুণ খুঁজে পাওয়া গেল: সঙ্গীতে, ব্যাকরণে, পঞ্চমুখী ঐশ্বর্যে। কিন্তু তাঁর সাফল্যের একটা বড় কারণ, তিনি হয়ে উঠলেন সঙ্কটমোচনের দেবতা— দিনে-রাতে যে কোনও সময় বিপদে পড়লে তিনি ভক্তের পাশে এসে দাঁড়াবেন। সমুদ্র উপকূলের মৎস্যজীবী বা জাহাজের নাবিকরা দরিয়ায় তুফান এলে পবনপুত্রের দয়া ভিক্ষা করেন, অসুস্থ মানুষ তাঁর কাছে বিশল্যকরণী চান। এই দেবতার কোনও বায়নাক্কা নেই, সবাই তাঁর ভক্ত হতে পারে, এমনকী মুসলিমরাও অনেকে তাঁকে বিপত্তারণ বলে মেনে নিলেন। উনিশ শতকে লখনউয়ের আলিগঞ্জে বেগম রাবেয়া তাঁর নামে মন্দির অবধি তৈরি করালেন।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, হিন্দুস্থানের এই দেবতাটির জীবনকাহিনি অনেক পর্বের মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। ছুটি পাওয়ার লোভে আমরা বাঙালিরা আরও অনেক নতুন-নতুন দেবতাকে বরণ করে নিতে পারি। তবে আমরা শান্তিতে বাঁচতে চাই।