নবরাত্রির সময় যখন ভারতের বহু অঞ্চলে মানুষ অনেক রকমের সংযম পালন করে আর এর একটা জরুরি অঙ্গ হল উপবাস। কিন্তু বাঙালিরা একদম বিপরীত।

আদি নবরাত্রি উৎসব ছিল বসন্তকালে, চৈত্র মাসে। কিন্তু নিঃসন্দেহে, শারদীয় নবরাত্রি বা অকালবোধনকে (রবিবার থেকে মহানবমী অব্দি) ভারতে প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে অনেক বেশি গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়।

এই ন’ দিনের ক্ষেত্রে মা দুর্গা নিয়ে সারা ভারত একমত হলেও ভারতের অন্যান্য প্রদেশের থেকে বাঙালির উৎসব প্রায় সবসময়ই যথেষ্ট আলাদা। প্রথমে দেখা যাক দুটি ট্র্যাডিশান কেমন পাশাপাশি চলে এসেছে। এক দিকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ভগবান রামচন্দ্রদের পূজো যা প্রচুর ঘটা করে শেষ হয় দশেরার দিন রাবন বধ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আর পাশাপাশি পূর্ব ভারতে মা দুর্গার যুদ্ধ আর জয়ের উৎসব। এই দুটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয় এই বলে যে রামচন্দ্র রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর আগে অসময়ে দুর্গাপূজো করেছিলেন। কৃত্তিবাসের রামায়নে এটি স্পষ্ট করা হয়েছে।

নবরাত্রির সময় যখন ভারতের বহু অঞ্চলে মানুষ অনেক রকমের সংযম পালন করে আর এর একটা জরুরি অঙ্গ হল উপবাস। তা ছাড়াও বেশির ভাগ মানুষেরা কঠোর ভাবে নিরামিষাশী থাকেন। সে সব জায়গায় নবরাত্রি পালনের অনেক কট্টর পরিবারে ভাত-রুটি, ময়দা, সুজি, এ সবও খাওয়া চলে না। মশলাপাতির ব্যাপারেও কঠোর নিয়ম রয়েছে: জিরে, ধনে, এলাচ, জোয়ান, পুদিনা, কাঁচা লঙ্কা, আমচুর আর আদা ছাড়া অন্য কিছুর ব্যবহার নিষিদ্ধ। তরিতরকারি আর ফলমূলেও বাধানিষেধ আছে। রান্নায় দেওয়া চলবে না ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, হিংও।

কিন্তু বাঙালিরা একদম বিপরীত। কয়েকটি গোঁড়া পরিবার কিছু নিয়ম বা ব্রত পালন করলেও, সাধারণ লোকেরা কব্জি ডুবিয়ে মাছ-মাংস খেতে ব্যস্ত। ভোগ পেলে ছাড়ে না, আবার পুজোর আগে থেকেই ঠিক করা হয় কোন দিন বাঙালির কষা মাংস, কবে হবে চাইনিস আর কোথায় বেস্ট মোঘলাই খানা। ওদের সর্বসাধারণের উৎসব শুধু এক দিনের, দশেরার সময়। আমাদের তো প্যান্ডেল বানাতেই দু তিন মাস আর উৎসব পঞ্চমী থেকে দশমী। আর একটু টানতে পারলে আরও ভালো।

ভূগোল এবং ভৌগোলিক দূরত্ব আচার-ব্যহার আর ভাষার বৈচিত্রের মাধ্যমে যত বিভিন্নতাই তৈরি করুক না কেন, ধর্ম আর সংস্কৃতি ভারতকে বরাবর একটা সংহতি দিতে পেরেছে।

অন্য দিকে, নবরাত্রির সময়েই উত্তর ভারতের কিছু কিছু এলাকায় বলিদান প্রথা পালিত হয়। রাজস্থানের রাজপুতরা এবং দেশের অনেক রাজপরিবার আর যোদ্ধা-গোষ্ঠীও কুলদেবীর কাছে মোষ বা ছাগল বলি দেন। হিমালয়ের পাদদেশে এবং পূর্ব ভারতে অনেক জায়গায় মোষ বলি প্রচলিত। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা বলিপ্রদত্ত প্রাণীর কানে গায়ত্রী মন্ত্র বলেন, যাতে সেই প্রাণীটি পরজন্মের ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পায়। প্রসঙ্গত, ইসলাম ধর্মের মানুষের ইদ-উল-জুহায় কুরবানির আগেও একই রকম রীতি অনুসৃত হয়।

নিরামিষ খেয়েই হোক আর বলি দিয়েই হোক, নবরাত্রি উৎসবের একটা বড় উদ্দেশ্য হল সু-ফসলের প্রার্থনা। মহারাষ্ট্রে এই উৎসব পালন করা হয় ঘট-স্থাপনা উৎসবের মধ্যে। চার পাশে এক তাল মাটির মধ্যে একটি জলপূর্ণ মাটির কলসি স্থাপন করা হয়। সেই মাটিতে হরেক রকমের শস্যদানা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে এই ন’দিনে তারা অঙ্কুরিত হয়। ঘট-স্থাপনার এই পুরো উদ্‌যাপন যে একটা উর্বরতা এবং উৎপাদনের ধারণা থেকেই এসেছে, তা বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন দেখি, গুজরাতিরা এই অনুষ্ঠানকে ‘গরবা’ বা গর্ভ নাম দেন। তাঁদের প্রসিদ্ধ ‘গরবা’ নাচও হয় এই মাটির কলসিকে ঘিরেই। সেই কলসির মধ্যে একটা প্রদীপও জ্বালানো থাকে। ডান্ডিয়া-রাস উৎসবের সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘গরবা’ অবশ্য পরে তার আদি রূপ থেকে খানিকটা সরে এসেছে। অন্যান্য অনেক জায়গায় যাগযজ্ঞ করে আর বিশেষ ‘সোনালি পাতা’ দিয়ে এই ঘটের পূজা হয়। গোয়ায় এই পাত্র সাধারণত তামা দিয়ে তৈরি হয় এবং এই সময়েই নানান গোষ্ঠীর মানুষ শস্য রোপণের উত্সব করেন।

দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে এই উৎসবের সময় একটা অদ্ভুত প্রথা চলে। কাঠের পাটাতনের ওপর ছোট্ট ছোট্ট কাঠের পুতুল সাজিয়ে রাখা হয়। একে অনেক জায়গায় ‘বোম্মাই কুলা’ বা ওই গোছের নানা নাম দেওয়া হয়েছে। এই পুতুলের সারি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় প্রাত্যহিক জীবনের নানা ছবি, আবার তার পাশাপাশি সরস্বতী, পার্বতী এবং লক্ষ্মীর মূর্তিও থাকে। অন্ধ্রপ্রদেশে আর মহীশূরে এই উৎসব পালন করা হয় পাণ্ডবদের যুদ্ধজয়ের উদ্‌যাপনের লগ্ন। সুতরাং আমরা নবরাত্রি পালন করার অনেক রকম কারণ পাই।

কিন্তু ধর্মীয় উৎসব বিষয়ে আমরা যত বেশি জানার চেষ্টা করি, ততই একটা ব্যাপার দেখতে পাই। ভূগোল এবং ভৌগোলিক দূরত্ব আচার-ব্যহার আর ভাষার বৈচিত্রের মাধ্যমে যত বিভিন্নতাই তৈরি করুক না কেন, ধর্ম আর সংস্কৃতি ভারতকে বরাবর একটা সংহতি দিতে পেরেছে।

No comments on 'ওদের নবরাত্রি, আমাদের দুর্গা দুর্গা'

Leave your comment

In reply to Some User